হাসপাতালের আইসিইউ বেডেই কি আমাদের মৃত্যু হবে?

বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সামাজিক শ্রেণীতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এই মানুষগুলোর অধিকাংশ একাধিক ও দীর্ঘস্থায়ী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করছে।
জীবনের শেষ দিনগুলোতে তারা বাড়িতে থাকার পরিবর্তে, একটি অপরিচিত পরিবেশে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) থাকে। উল্লেখ্য, পরিবারের সদস্য, শুভাকাক্সক্ষী এবং বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে- চিকিৎসা সরঞ্জামে ভরা ছোট্ট সীমিত স্থানে মৃত্যু আজকাল আরও সাধারণ হয়ে উঠছে।
অনেকে বিদেশে অনেক অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে। এতে অনেক সময় তাদের কিংবা সন্তানদের সম্পদ ও সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ নিঃশেষ হচ্ছে। এভাবে একটি অসহায় ও বিচ্ছিন্ন পরিবেশে- দেহের ভিতর অসংখ্য নালী আর তারে আটকে মানুষ কৃত্রিম ও বিচিত্র পরিবেশে একাকী মৃত্যুবরণ করছে।
হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর এই ক্রমবর্ধমান প্রবণতার কারণগুলো হলো- ১) বাংলাদেশে বয়স্ক জনসংখ্যা তুলনামূলক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যারা একাধিক স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে; ২) যারা মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক বছর ধরে দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগে; ৩) স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন সুবিধার সম্প্রসারণ এবং সহজীকরণ; ৪) বৃহত্তর সামাজিক শ্রেণীর আয়ের পরিমাণ এবং সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে- যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে বেসরকারি অভিজাত হাসপাতালে উচ্চ ফি প্রদান করতে পারে।
দুঃখজনক বাস্তবতা যে, এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনের জীবনকে আরও কয়েক দিন বা মাস দীর্ঘায়িত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। এটি সত্য যে, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা তাদের মৃতপ্রায় পরিবারের সদস্যদের জীবনকাল দীর্ঘায়িত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সময় এবং সম্পদ ব্যয় করে। তবে নিম্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর মানুষেরা এর কিছুই করতে পারে না। এখানে দেখার বিষয় হলো মৃত্যুর এই ব্যয়বহুল প্রবণতা থেকে কারা লাভবান হচ্ছে?
অনেক ক্ষেত্রে, জীবনের শেষ সময়ে, দুর্বল রোগীদেরকে দ্রুত আইসিইউ, সিসিইউ কিংবা অন্য হাসপাতালের ইউনিটে নেয়া হয়। যেখানে উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন পেশাদার ব্যক্তির সেবা প্রয়োজন। মৃতপ্রায় ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা প্রচুর অর্থ খরচ করে এই উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় বহন করে। বিলের সময় দেখা যায়, কিছু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও এবং ডাক্তাররা উচ্চ লাভের আশায় ইচ্ছাকৃতভাবে চিকিৎসা সেবা ব্যয়বহুল ভাবে উপস্থাপন করে।
হাসপাতালের এই কৃত্রিম ও অপরিচিত পরিবেশে- যেখানে নেই কোন আত্মীয়, নেই কোন প্রিয়জন- সেখানে মৃত্যুকে বরণ করার কি এতো প্রয়োজন? নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেয়া হলে কি মানুষ হাসপাতালে এভাবে মৃত্যুবরণ করবে? তারা তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে কোথায় চিকিৎসা করতে চায়, একথা কেউ জিজ্ঞাসা করে কি? অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং অস্বস্তিকর বিষয় যে, নিবিড় পর্যবেক্ষণ কিংবা পেশাদার যত্ন; কোন কিছুই স্বাস্থ্যের কোনও অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পারে না। বড়জোর পারে কয়েক ঘন্টা বা দিনের বেশি বা কয়েক মাস জীবন দীর্ঘায়িত করতে।
আগেই বলা হয়েছে, হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে চিকিৎসার নামে নানানভাবে টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। শেষ পর্যায়ে তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কী করা উচিত? তারা কি রোগীকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলবে? তখন কি এটা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য হবে? এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত? আমেরিকা এই পরিস্থিতিতে কীভাবে করছে?
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন রিপোর্টে বিশ্লেষকরা প্রাকৃতিক মৃত্যুর উপর জাতীয় স্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে ২০০৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর স্থান পরিবর্তনের মূল্যায়ন করেছেন। ২০০৩ সালে, হাসপাতালে মোট ৯০৫,৮৭৪ জন মারা গেছে (৩৯.৭ শতাংশ), যা ২০১৭ সালে কমে ৭৬৪,৪২৪ (২৯.৮ শতাংশ) হয়েছে; নার্সিং সুবিধায় মৃত্যুর সংখ্যা ৫৩৮,৮১৭ (২৩.৬ শতাংশ) থেকে কমে ৫৩৪,৭১৪ (২০.৮ শতাংশ) হয়েছে যেখানে একই সময়ে বাড়িতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৪৩,৮৭৪ (২৩.৮ শতাংশ) থেকে বেড়ে ৭৮৮,৭৫৭ (৩০.৭ শতাংশ) হয়েছে। হাসপাতাল সুবিধাগুলিতে মৃত্যুর সংখ্যাও ৫,৩৯৫ (০.২ শতাংশ) থেকে ২১২,৬৫২ (৮.৩ শতাংশ) বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালের তুলনায় বাড়িতে বেশি লোক মারা যাচ্ছে এবং গবেষকরা মন্তব্য করেছেন যে বাড়িতে মারা যাওয়া আরও বাড়তে থাকবে।
কিন্তু বাংলাদেশের মধ্য ও উচ্চ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর মানুষের হাসপাতালে মৃত্যুর এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ঘরে যে প্রফেশনাল যত্ন পায়, তা বাংলাদেশে অস্বাভাবিক এবং অপরিচিত।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে মৃত্যু ও মৃত্যুর পরিস্থিতি এবং কারণ পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশে মানুষ এখন সংক্রামক রোগে নয় (দুর্ঘটনা, সহিংসতা এবং অন্যান্য আঘাতজনিত মৃত্যু ব্যতীত), বরং বৃদ্ধ বয়সে দীর্ঘস্থায়ী রোগে মারা যাচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে স্বাভাবিক এবং ধীর মৃত্যুর প্রক্রিয়া মানুষকে আগে থেকে পরিষ্কারভাবে ভাবার সুযোগ দেয়। তারা জীবনের শেষ দিনগুলো কোথায় থাকতে চায়, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জীবনের শেষ দিনগুলো প্রিয়জনদের সাথে বাড়িতে থাকা ও বাড়িতে মৃত্যু বৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হয় যে, আমেরিকানরা মানুষের শেষ ইচ্ছাকে সম্মান করে।
এখন দেখার বিষয়, আমরা বাংলাদেশে প্রিয়জনদের জীবনের শেষ দিনগুলো কিভাবে কাটবে, তা বেছে নেওয়ার জন্য কতটা প্রস্তুত?
লেখক: অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান, জনস্বাস্থ্য বিভাগ,
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এগ্রিকালচার
অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)।
(ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সাদিক হাসান পলাশ)
সাদিক পলাশ / সাদিক পলাশ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
