রাজনীতি করছেন পিটার হাস !

সুই হয়ে ঘরে ঢুকে ফাল হয়ে বের হওয়া ভিলেনের চরিত্র বাংলা সিনেমার এক অন্যতম প্রধান চরিত্র। এই সুই চরিত্রটি কখনো স্বজনরূপে, কখনো স্থানীয় কখনো ভিনদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস ঘাটলে জানা যাবে, ভারত উপমহাদেশে তাদের আগমন, দখল এবং নির্যাতনের ইতিহাস অনেকটা তেমনই। আর সিনেমার গল্প তো জীবন থেকেই নেয়া।
সিনেমায় থাকে পরিবারের গল্প। আজ বলতে বসেছি বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্টের কথা। রাষ্ট্র থাকলে রাষ্ট্রের প্রতিবেশি থাকবে, সহযোগী থাকবে। এর মানে এইসব প্রতিবেশি কিংবা সহযোগী দেশ কখনো স্বাগতিক দেশের রাজনীতিতে অংশ নিতে পারেন না। এটা আমি না, বলছে ভিয়েনা কনভেনশন। বৈশ্বিক রাজনীতিতে এমন আইনের প্রয়োজনীয়তা ছিলো আদি থেকেই। এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে।
সম্প্রতি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ সরগরম বাংলাদেশের রাজনীতি। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানববন্ধন, সমাবেশ, মিটিং-মিছিল চলছে হরহামেশাই। আর এইসব রাজনৈতিক ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে কথা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্, কখনো বলছেন তাদের রাষ্ট্্রদূত, কখনো নিজেরাই জানাচ্ছেন। যা ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের সম্পূর্ণ বিপরীত।
মূলত জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আগে থেকেই বিদেশি কূটনীতিকদের সতর্কও করা হয়েছে। কেননা অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করতে গিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশের রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন।
পিটার ডি. হাস একজন মার্কিন কূটনীতিক যিনি ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ১৪ ডিসেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের রাজধানীর শাহীনবাগের বাসায় যান। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু লোক মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ঘিরে ধরেন। তারা ১৯৭৫ সালের গুমের ঘটনা ও সামরিক শাসনামলে জিয়াউর রহমান কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ‘মায়ের কান্না’ নামে একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতের কাছে স্মারকলিপি দিতে চান। রাষ্ট্রদূত ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে যান। তিনি অনেক বেশি বিব্রত বোধ করেন। তিনি ওই স্মারকলিপি গ্রহণ না করে দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়েন। ওখান থেকে ফিরেই ওইদিন দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন পিটার হাস। বৈঠকে রাষ্ট্রদূত তার ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা উল্লেখ করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে যাওয়ার খবর কে প্রচার করল, সেটি রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চান। পাশাপাশি মোমেন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, রাষ্ট্রদূত বা দূতাবাসের কর্মকর্তারা চাইলে আরও নিরাপত্তা দেবে সরকার। এদিকে, ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি নেই বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, ৯ বছর আগে নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাড়িতে পিটার হাসের যাওয়ার আগে তার এই সফরের বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো উচিত ছিল। ১৮ ডিসেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রাষ্ট্রদূতের এই সফর ভুল ছিল বলেও মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
শাহীনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সঙ্গে কথা বলেছেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তখন ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সঙ্গে ডোনাল্ড লু’র আলোচনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ঘটে যাওয়ার ঘটনার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তার বিষয়টিতে উদ্বেগ জানিয়েছেন লু।
সেই ঘটনার পর ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটিতে শাহীনবাগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে শাহীনবাগের ঘটনার পর পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগের বিষয়টি ঢাকাকে স্পষ্ট করেই জানানো হয়েছে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপপ্রধান মুখপাত্র ভেদান্ত প্যাটেল বলেন, ঢাকায় রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যেহেতু কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কূটনীতিকরা হস্তক্ষেপ করতে পারে না, তাই নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিষয়েও তারা হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বরং সরকারি দল এবং বিরোধীদল অর্থাৎ সকল রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়িত্বশীল হয় তবে বিদেশিদের নাক গলানোর কোনো সুযোগ থাকে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়েও বিদেশি কূটনীতিকরা এমন কোনো মন্তব্য করতে পারেন না যেটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল।
ওই বিবৃতিতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৪৮ সালে প্রণীত জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা বলা হয়। ওই কূটনীতিকদের নিশ্চয়ই মনে আছে বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সর্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী অবৈধ সরকারগুলো সংবিধানের সুরক্ষিত এই মানবাধিকারগুলো বারে বারে ভূলুণ্ঠিত করেছে। বেয়নেটের খোঁচায় সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। কূটনীতিকরা কি ভুলে গেছেন সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা থেকে উৎসারিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি আন্তর্জাতিক চুক্তি (covenants) অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের International covenant on economic social and cultural rights Ges International covenants on civil and political rights জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যথাক্রমে ১৯৯৮ এবং ২০০০ সালে অনুসমর্থন করার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এই চুক্তি দুটিতে পক্ষভুক্ত হয়েছিল। খালেদা জিয়ার ১০ বছরের শাসনামলে মানবাধিকারের কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বাংলাদেশ অনুসমর্থন করেনি। অসাংবিধানিক সরকারগুলোর সময়ও এরকম চিত্র ছিল। জাতির পিতার সরকার ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রায় সকল চুক্তিই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের সময় অনুসমর্থন করা হয়েছে।
হাস ১৯৮৮ সালে ইলিনয় ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে জার্মান ও আন্তর্জাতিক শিক্ষায় স্নাতক এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ইউনাইটেড স্টেটস ফরেন সার্ভিসে যোগদানের পর, হাসকে প্রথমে মরক্কোতে মার্কিন দূতাবাসের অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। হাস ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসে এক বছরের জন্য ডেস্ক অফিসার হিসাবেও কাজ করেছেন এবং লন্ডনে মার্কিন দূতাবাসের একজন অর্থনৈতিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুম্বাইয়ের মার্কিন যুক্তরাষ্টের কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত, হাস ভারপ্রাপ্ত স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশনের জন্য কাজ করেছেন। এরপর হাস ওয়াশিংটন, ডিসিতে বদলি হন, যেখানে তিনি অর্থনীতি ও ব্যবসা বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সহকারী সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৯ জুলাই, ২০২১-এ, রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বাংলাদেশে পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে হাসকে মনোনীত করেন। সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটি তার মনোনয়নের বিষয়ে ২০ অক্টোবর, ২০২১-এ শুনানি করে। কমিটি মনোনয়ন সম্পর্কে ৩ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে অনুকূল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে, কন্ঠ ভোটের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে রাষ্ট্রদূত হিসেবে হাসকে নিশ্চিত করা হয়। ১৫ মার্চ, ২০২২ তারিখে, হাস বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের কাছে তার পরিচয়পত্র পেশ করেন।
কথা হলো, রাষ্ট্রদূতদের নিজস্ব কিছু দায়িত্ব আছে। তাদের কাজ হলো এখতিয়ারের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করা। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয় এমন কোনো কাজ করা রাষ্ট্রদূতদের জন্য এখতিয়ার বহির্ভুত কাজ। বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার অনুরোধ থাকবে, এখানে কর্মরত সকল রাষ্ট্রদূতরা ভিয়েনা কনভেনশন মেনে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। যা তাদের এবং আমাদের উভয়ের জন্যই স্বস্তিদায়ক এবং আনন্দঘন। অন্যথায় সম্পর্কের উষ্ণতা একটু কমবে বৈ বাড়বে না-এটা নিশ্চিত।
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
