ঢাকা মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা এবং স্বাধীনতার পূর্ণতা প্রাপ্তি


সুকান্ত দাস photo সুকান্ত দাস
প্রকাশিত: ৭-১-২০২৩ দুপুর ৩:১৬

নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেধীন আওয়ামী লীগ  বিপুল ভোটে জয়ী হলেও বিজয়ী জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা দেয়নি পাকিস্তানিরা।ক্ষমতা  হস্তান্তর নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তালবাহানা শুরু করে ইয়াহিয়ার সরকার। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে স্বাধীনতাকামী আপামর বাঙালী।আন্দোলন - সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালী জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত  নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী। এই রাতেই গ্রেফতার করা হয় সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের পর তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। নয়মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী বিজয় অর্জন করে। ব্রিটিশদের ২০০ বছর এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ২৩ বছর শোষণের পর মুক্ত হয় বাংলার মাটি।স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু যে মহান ব্যাক্তির জন্য বাঙালী স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে সেই মহান ব্যাক্তির অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার পূর্ণ আনন্দ এদেশের মানুষ উপভোগ করতে পারছিলো না।দেশ স্বাধীনের পর সকলের মুখে ছিলো শুধু একটাই কথা, আর তা হলো বঙ্গবন্ধু কবে ফিরবেন। তাকে ছাড়া যে এই স্বাধীনতা অপূর্ণ। তার কথায় এদেশের আপামর জনগণ মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং লাখো শহীদ এবং মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলো শাসক গোষ্ঠীর হাত থেকে। স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই মানুষটার অভাবে রিক্ত ছিলো এদেশ,অপূর্ণ ছিলো এ স্বাধীনতা।

১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি সেই মহান ব্যাক্তি ফিরে এলেন বাংলার মানুষের মাঝে।যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশে শান্তির হাওয়া বয়ে গেছিলো তার প্রত্যাবর্তনে।পাকিস্তানী হায়েনা ও এদেশীয় রাজাকারদের দ্বারা অপবিত্র হওয়া দেশের মাটি পবিত্র হয়েছিল তার পদস্পর্শে।

পাকিস্তানীরা একদিকে এদেশের মানুষের উপর চালিয়েছিলো নৃশংস তান্ডব অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চালিয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। এদিকে মুক্তিকামী বাঙালী স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামী হিসেবে মৃত্যুর ক্ষণ গুনছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে যে সেলে তিনি বন্দী ছিলেন সেই সেলের সামনেই তার জন্য কবর খোঁড়া  হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে। বিজয়ী বাঙালী জাতি উদ্বেগ - উৎকন্ঠার সাথে নেতার ফিরে আসার অপেক্ষা করতে থাকে। বাংলাদেশের জনগণের পাশাপাশি বিশ্বের শান্তিকামী মানুষও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার  হয়ে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুকে আটকে রেখে পাকিস্তানের স্বার্থে কিছু ফায়দা তোলার মতলব ছিলো ভুট্টার। ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে শারীরিক নির্যাতন করেছিলো আর তারপর  ভুট্টো শুরু করেছিলো মানসিক নির্যাতন। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হয়নি।আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি পান।পাকিস্তান থেকে সরাসরি লন্ডন আসেন তিনি। তখনকার পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা চায়নি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে সরাসরি বাংলাদেশে ফিরুক। তাছাড়া তখন ভারতের আকাশ পথ ব্যবহারের অনুমতি ছিলো না পাকিস্তানের। তারা বঙ্গবন্ধুকে ইরান বা তুরস্কে যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাতে রাজী হননি।পরে তাকে লন্ডনে যাওয়ার কথা বলা হলে তিনি রাজী হন। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ ভোর সাড়ে ছয়টায় তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান।

লন্ডনে বঙ্গবন্ধু ক্ল্যারিজ'স হোটেলে ছিলেন। তার আসার খবর পেয়ে ব্রিটেনে অবস্থানরত বাঙালীরা বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য তীব্র ঠান্ডা এবং বৃষ্টির মধ্যেও হোটেল সংলগ্ন রাস্তায় ভীড়  করেন।বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে জানালা থেকে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন।তিনি  সবার কাছে দেশের মানুষের কথা জানতে চান।যার সাথে আলাপ  হয় তার কাছেই এক কথা জিজ্ঞেস করেন, আমার দেশের মানুষ কেমন আছে।

লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে গান্ধীজির মতো সম্মান প্রদান করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি না হওয়া সত্ত্বেও তাকে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র প্রধানের সমান প্রটোকল দেওয়া হয়েছিল।

৮ জানুয়ারি ব্রিটেনের তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা যিনি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হন, হ্যারল্ড উইলসনও ক্ল্যারিজ'স হোটেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে মি. প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করেন। ৮ জানুয়ারি বিকালে তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড  হিথ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠক করেন। হিথ তার সরকারি সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে এসেছিলেন শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য।

সবথেকে মজার ব্যাপার হলো যাবতীয় রীতি উপেক্ষা করে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে বহন করা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলে যতক্ষণ না বঙ্গবন্ধু গাড়িতে ওঠেন।এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি।তখনও কিন্তু ব্রিটেন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।পরে এই ব্যাপারে হিথ বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান হলেন একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর।তাকে এই সম্মান প্রদর্শন করে আমরা সম্মানিত হয়েছি।

৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। পথে দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন তিনি। দিল্লিতে  ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি,প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সহ তার মন্ত্রীসভার সদস্যরা বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। দিল্লিতে বঙ্গবন্ধু ভারত সরকার এবং ভারতের জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানান।বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি।

এরপর দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। লাখ লাখ মানুষ  প্রিয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হয়।বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে যান।সেখানে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিল শুধু তাকে দেখার জন্য, তার মুখের দুটো কথা শোনার জন্য।দেশের মানুষের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা শুনে বার বার চোখ ভিজে যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর।  মঞ্চে উঠেও তিনি আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের স্বাদ পূরণ হয়েছে। বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামে সাহায্যকারী সকল দেশ, দেশের জনগণ এবং রাষ্ট্র প্রধানকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

বাঙালী জাতির জীবনে সবথেকে কাঙ্খিত মুহুর্তের একটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির দুপুর ১ টা ৪১ মিনিট। কারণ এই সময় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পা রাখেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে। লাখ লাখ মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে।জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এই স্লোগানে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ বাতাস।

পৃথিবীতে  বাঙালী জাতি যতদিন  থাকবে  ১০ই জানুয়ারি ততদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ ১৯৭২ সালের এই দিনই যে স্বাধীন বাংলাদেশর কারিগর দেশে ফিরে এসেছিলেন।


সুকান্ত দাস
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া 

প্রীতি / প্রীতি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া