চীন আমাদের উন্নয়ন সহযোগী, শত্রু নয়

সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়- নীতিতে বিশ^াস করে বাংলাদেশ। আমরা জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছি।সংবিধান অনুযায়ী আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো- রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি সম্মান বজায় রেখে, অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ না করা এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য সংগ্রাম করা; প্রতিটি মানুষের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলাকে সমর্থন করা এবং সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা বা জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সারা বিশ্বের সকল নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
আমাদের সংবিধান বলছে, কোনো দেশই আমাদের শত্রু নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একই কথা বলে গেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ফরেন পলিসি বলছে, ‘বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলে মার্কিন অংশীদারদের অনুসৃত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর এই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের লক্ষ্য মূলত চীনকে ঠেকানো বা মোকাবিলা করা। বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এতে আরও বলা হয়, গত মাসে (ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ তার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকের একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এই খসড়াতে এমন উদ্দেশ্যগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে; যা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রতিফলন করে। যেমন (ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে) একটি মুক্ত, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ অঞ্চলের প্রয়োজন বলে চূড়ান্ত খসড়ায় উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ।’ প্রতিবেদনটিতে মুক্ত, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। ফরেন পলিসিরি প্রতিবেদনের একটি বিষয়ে আমার জোর আপত্তি রয়েছে। এখানে বলা হয়েছে চীনকে মোকাবিলা করতে বা ঠেকাতে মার্কিন বলয়ের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। আসলে এটা মোটেও ঠিক না। কারণ আমাদের অবকাঠামো খাতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক বাণিজ্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও আমাদের অনেক বাণিজ্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একে অপরের ‘শত্রু দেশ’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু উভয় দেশই আমাদের বন্ধু এবং তাদের সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট সুসম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং চীনকে ঠেকানোর প্রশ্নই আসে না। আমরা যুক্তরাষ্ট্রকেও ঠেকাতে চাই না। তবে সবার সাথে সুসম্পর্ক রেখে আমরা উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চাই।
ভৌগোলিক কারণে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির মূল কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। এর অবস্থান, অপার অর্থনীতির সম্ভাবনা, বিশাল বাজার ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে বৃহৎ শক্তিগুলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে কৌশল তৈরি করেছে। বাংলাদেশসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো বৃহৎ শক্তিদের প্রতিযোগিতামূলক অগ্রসরতা থেকে লাভবান হতে পারে। কেননা, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। ফলে বাংলাদেশ রয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে। এই অঞ্চলের গুরুত্বায়ন বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি করে বহুলাংশে। আর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ উপসাগর হলো বঙ্গোপসাগর। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার এই সাগরের জলসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে। ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটারের জলসীমায় বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার সমুদ্রজুড়ে অর্থনৈতিক ও নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের। এর পশ্চিমে ভারত আর পূর্বপ্রান্তে থাইল্যান্ড। বাংলাদেশ ছাড়াও সাগরের তীরবর্তী অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। সাগরের ওপর পরোক্ষ নির্ভরশীলতা রয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য কয়েকটি দেশেরও। বিশ্ববাণিজ্যে পরিবাহিত পণ্যের এক-চতুর্থাংশ যায় বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি স্বল্পতায় ভোগা দেশগুলোয় পারস্য উপসাগর হয়ে পরিবাহিত জ্বালানি তেল ও এলএনজির নিরাপদ করিডোর বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করে বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগরের ওপর। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন অন্য দেশগুলোর অবস্থাও একই। এই উপসাগর আবার প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। ভূ-রাজনীতি, বঙ্গোপসাগরে সার্বভৌমত্ব ও একটি অগ্রসরমান অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভৌগোলিকভাবে প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের ইন্দো-প্যাসিফিক মানচিত্রে বাংলাদেশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) বা কৌশলের প্রধান লক্ষ্য হলো অঞ্চলটিকে অবাধ, মুক্ত, সংযুক্ত, সমৃদ্ধ, সুরক্ষিত এবং স্থিতিস্থাপক করে তোলা। কাউকে ঠেকানো বা বাধা দেওয়ার বিষয়টি এখানে আসছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যেহেতু ‘চিরশত্রু’ দুই দেশ, সেহেতু এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য স্বাভাবিকভাবেই চীনের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। আবার ভারত ও চীন ‘চিরশত্রু’ দুই দেশ। একই সঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন- এই তিন দেশেরই বন্ধু বাংলাদেশ। সুতরাং তাদের বিবাদে বাংলাদেশকে টেনে নেওয়ার কোনো যুক্তি বা কারণ আছে বলে মনে হয় না। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির রাজনৈতিকভাবে ভিশনগুলো হচ্ছেÑ প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে সম্মান, শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্বন্দ্ব নিরসন, স্বাধীন ও উন্মুক্ত বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ শুধু এগিয়ে যেতে চায়। আমরা কারো অগ্রসরে বাধা হইনি, হবো না। সব দেশই নিজ নিজ পলিসি নিয়ে ছোট দেশগুলোকে নিজেদের পরিকল্পনায় যুক্ত করতে চাচ্ছে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য খাতে লাভবান হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং এর বিস্তৃত অঞ্চল এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অংশ। বড় দুটি অঞ্চলের সেতুবন্ধনকারী বাংলাদেশ যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। সস্তা শ্রম, অবকাঠামো ও কৌশলগত অবস্থান কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে পণ্য সহজেই ভারতে ও আসিয়ান অঞ্চলে রপ্তানি করা যাবে। এছাড়া সমুদ্র অর্থনীতি, খনিজসম্পদ আহরণ, পোর্ট ট্রানজিট ব্যবহারের অনুমতি দিয়েও বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি চিঠি পাঠান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে বলা হয়, সবার জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনবে এমন স্বাধীন, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন বিষয়ে বাংলাদেশ একমত পোষণ করে।
ফরেন পলিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং কয়েকটি মার্কিন প্রধান প্রধান মিত্র ইঙ্গিত দিয়েছে যে বাংলাদেশেরও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হওয়া উচিত। গত সপ্তাহে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা নয়াদিল্লিতে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তৃতাকে এই অঞ্চলের জন্য একটি ‘নতুন পরিকল্পনা’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তিনি নতুন অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তিসহ বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া চলতি মাসেই যুক্তরাজ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক মন্ত্রী অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ান বাংলাদেশ সফর করেন। এই দেশগুলো কেন বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে অংশ হতে বলছে তা বোঝা বেশ সহজ। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত, ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়া ছাড়াও এই দেশটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া; উভয়ের প্রবেশদ্বার হিসেবেই কাজ করে। ঢাকার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে চায় এবং ঢাকার কোনো নিরাপত্তা লক্ষ্য নেই। বাংলাদেশ এমন ইঙ্গিত এখনও দেয়নি যে, দেশটি চারদেশীয় জোট কোয়াডে যোগ দেবে।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
এমএসএম / এমএসএম

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও বাস্তবতা

গাজায় যুদ্ধের নৃশংসতা ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত

বন্ধ হোক অপসাংবাদিকতা

বিভাজনের রাজনীতি দেশের জন্য হুমকি হতে পারে

প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্নের সৌদি আরব

শারদীয় দুর্গোৎসবে সম্প্রীতির বাংলাদেশ ভাবনা

দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজন পর্যটন গন্তব্যগুলোর সামগ্রিক উন্নয়ন এবং শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং

গণতান্ত্রিক অধিকার ও নতুন নেতৃত্বের অন্বেষণ

দুঃখই সবচেয়ে আপন

জাতিগত নিধন বন্ধে জাতিসংঘের ব্যর্থতা

গণতান্ত্রিক হতে হলে মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখতে হয়

স্মার্ট ডিভাইস-আসক্তিতে বিপদগামী হচ্ছে শিশু-কিশোররা
