ঢাকা মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার কাজে খুশি ছিল পাক আর্মি


সাজেদা হক       photo সাজেদা হক
প্রকাশিত: ৮-৪-২০২৩ বিকাল ৫:২

বাবা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ নিয়ে আমার আগ্রহের সীমা অসীম। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ নামের এই স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড, লাল-সবুজের পতাকা এবং পাসপোর্ট পেয়েছি কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারণে। শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় মনোবল, অটল বিশ^াস আর অদম্য সাহসের কারণেই আজ আমরা বাংলাদেশি। 

আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হতো না। কারণ যেভাবে একজন সাধারণ কিশোর খোকা থেকে জাতির জনক হয়ে উঠেছেন তা কেবল একজীবনের ত্যাগ, সময়, মেধা, শ্রম, সাহসিকতা, দৃঢ়তা এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অধিকারী না হলে সম্ভব হতো না। বলছি না, মুক্তির যুদ্ধে তিনিই একমাত্র যোদ্ধা। কারণ সৃষ্টি কখনো একজনে হয় না। এজন্য প্রয়োজন বহু মানুষের, ত্যাগের-তিতিক্ষার, সময়ের, মেধার, পরিশ্রমের। তারপরও কেউ কেউ সম্মুখে থাকেন, কেউ কেউ চিন্তা-চেতনায় থাকেন, কেউ সমর্থক থাকেন। কারো কারো অবদানকে অস্বীকার করা, এড়িয়ে যাওয়া কিংবা বিতর্কিত করা কখনোই সমীচীন নয়। 

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) তার অ ঞধষব ড়ভ গরষষরড়হং বইয়ে উল্লেখ করেছেন, প্রথমে তিনি (জিয়া) নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন। মইদুল হাসান তার ‘মূলধারা ৭১’ বইয়ে লিখেছেন, মেজর জিয়া শেখ মুজিবের নির্দেশে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা বললেও নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে করা আগেকার ঘোষণা সংশোধন করেননি। ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ বিষয়ক ইতিহাস ‘ভারত রক্ষক’ শিরোনামবিশিষ্ট সাইটের ৯৩তম পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া ২৬শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। যে কারণেই স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বীর উত্তমের মতো রাষ্ট্রীয় উপাধী দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উপ-সেনাপ্রধান বানানো হয়। প্রশ্ন তো সেখানে না, প্রশ্ন হলো স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ড কতটা স্বাধীন দেশের পক্ষে ছিল? 

মুক্তিযোদ্ধা এবং অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের একটি বক্তব্য ছিল এমন, মুক্তিযোদ্ধা দুই রকমের। এক ধরনের মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছায় গেছেন, তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯৯.৯৯ ভাগ ছিল না, ১০০ ভাগ ছিল-তা জেনেই যুদ্ধে গেছে। আরেক ধরনের মুক্তিযোদ্ধা ছিল ঘটনাচক্রে। জিয়াউর রহমান ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা না হলে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত থাকতেন না। ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা না হলে রাজাকারদের পদ দিতেন না।

অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের ব্যক্তিগত মন্তব্যের সাথে আমি একমত। আমরা এ-ও জানি, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রশংসিত আফিসার হিসাবে আইয়ুব খানের শাসনামলে বাংলাদেশে জিয়া ডেপুটেশনে ছিলেন। কাজ ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের উপর নজরদারী করা। কি পরিমাণ আস্থা থাকলেই তাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয় সে প্রশ্ন এখনো করা যায়। একাত্তরের উত্তাল রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থাতেও জিয়াউর রহমানকে পোস্টিং দেয়া হয় বাংলাদেশে। জিয়া পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে ছিল, তার প্রমাণ এই চিঠিটি।

Dacca
Major Zia Ur Rahman, Pak Army.
We all happy with your job. We must say, good job. You will get new job soon. Don`t worry about your family. Your wife and kids are fine.
You have to be more careful about Major Jalil.
Col. Baig Pak Army
May 29. 1971

ঢাকা
মেজর জিয়াউর রহমান, পাক আর্মি।
তোমার কাজে আমরা সবাই খুশি। আমাদের অবশ্যই বলতে হবে, তুমি ভালো কাজ করছ। খুব তাড়াতাড়ি তুমি নতুন কাজ পাবে।
তোমার পরিবার নিয়ে চিন্তা কোরো না। তোমার স্ত্রী ও সন্তানরা ভালো আছে।
মেজর জলিল সম্পর্কে তোমাকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
কর্নেল বেগ, পাক আর্মি। 
মে ২৯, ১৯৭১


শুধু গুপ্তচরবৃত্তিই নয়, বাংলাদেশ জন্মের মূল ভিতগুলো সুচতুরভাবে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮১ সময়কাল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়। ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে খুনি মোশতাক তার বিশ্বস্ত দোসর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর ‘চিফ অব আর্মি স্টাফ’ নিয়োগ করে। ১৯৭৫ সালের ৩০ আগস্ট খুনি মোশতাক-জিয়া চক্র এক অর্ডিন্যান্স জারি করে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে। যা লঙ্ঘন করলে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, খুনি মোশতাক-জিয়া চক্র বন্দুকের জোরে কুখ্যাত ‘ইনডিমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্টের খুনিদের সুরক্ষা প্রদান করে। কারণ মোশতাক ও জিয়া উভয়ই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খুনি চক্র ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সকল নিয়মনীতি ভঙ্গ করে কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানকে ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। এদিন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জেনারেল জিয়ার নিজস্ব বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪৬ ব্রিগেডের কিছু তরুণ অফিসারকে দিয়ে জিয়াকে গৃহবন্দী করেন এবং জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ৪ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ‘চিফ অব আর্মি স্টাফ’ পদে নিয়োগ পান। এদিকে ৪ নভেম্বর বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ছাত্রসমাজের উদ্যোগে প্রতিবাদী নীরব শোক মিছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এ মিছিল কলাবাগান এলাকায় পৌঁছলে খালেদ মোশাররফের বৃদ্ধা মাতা ও তার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ অংশগ্রহণ করে। বিষয়টি সকল ষড়যন্ত্রকারীর মাথা ব্যথা ও ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ক্যান্টনমেন্টে থেমে থেমে মাইকে ঘোষণা করা হতে থাকে ‘ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং তাদের সহযোগিতাকারী খালেদ মোশাররফকে হটাতে হবে। এরই মধ্যে জাতীয় চার নেতার দাফন সম্পন্ন হয়। খালেদ মোশাররফের দাবি অনুযায়ী ৫ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার অর্পণ করেন। ৬ নভেম্বর জাতীয় সংসদ বাতিল করা হয়। বিচারপতি সায়েম আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এদিকে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে আরেকটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ৬ নভেম্বর রাতেই তারা রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়। বিদ্রোহী সেনাদের গুলিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী সাহসী সেনাপতি মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর হুদা ও মেজর হায়দার নিহত এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলসহ কয়েকজন আহত হন। কর্নেল তাহের মুক্ত করেন জিয়াউর রহমানকে। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সকালে ঢাকার রাজপথ আবার সেনা ট্যাংকে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। জিয়াউর রহমান মুক্তি পেয়ে বেতার ভাষণের মাধ্যমে কোনোরকম নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে নিজেই নিজেকে সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। মুক্তি পেয়ে জিয়াউর রহমান প্রথমেই তার মুক্তিদাতা কর্নেল তাহেরের সাথে বেইমানি (ষড়যন্ত্রের ভেতর ষড়যন্ত্র) করেন। প্রকৃতপক্ষে ৭ নভেম্বরকে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্ধকার দিন অথবা মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস বা বেইমানি দিবসও বলা যেতে পারে। যদিও জিয়াউর রহমানের অনুসারী ও তার দল বিএনপি তারই মতো গায়ের জোরে দিনটিকে ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব দিবস’ বলে থাকে। ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে উপ-সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ১০ নভেম্বর উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসকদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। কিন্তু ১১ নভেম্বর সামরিক আইন প্রশাসকের পরিবর্তে উপ-সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান রেডিও ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। ২০ নভেম্বর জিয়াউর রহমান মেজর জেনারেল এরশাদকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করেন। ৫ ডিসেম্বর সাতজন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের সিদ্ধান্তে প্রচলিত আইনকানুন লঙ্ঘন করে সামরিক আদালতে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র এক আদেশে ১৯৭২ সালের দালাল আইন বাতিল করে। এরপর ঝবপড়হফ চৎড়পষধসধঃরড়হ ঙৎফবৎ ঘড়. ৩ ড়ভ ১৯৭৫-এর প্রথম তফসিল থেকে বাংলাদেশ দালাল আইনের যে সেফগার্ড ছিল তা তুলে দেওয়া হয়। দালাল আইনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এক অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী দালালদের বিচারের জন্য সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন। ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি দেশত্যাগী পাকিস্তানি নাগরিকদের নাগরিকত্ব ফেরত পাবার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলা হয়।

১৯৭৬ সালের ৩ মে জিয়াউর রহমান এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদ বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নষ্টপথ উন্মোচন করেন। ঝবপড়হফ চৎড়পষধসধঃরড়হ ঙৎফবৎ ঘড়. ৩ ড়ভ ১৯৭৬ জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলী তুলে দেওয়া হয়। ঝবপড়হফ চৎড়পষধসধঃরড়হ জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। যা ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল সংবিধানের নবম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনে পরিণত করেন জিয়াউর রহমান। চৎড়পষধসধঃরড়হ ঘড়. ১ ড়ভ ১৯৭৭ জারি করে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের কিছু অংশ তুলে দেওয়া হয়। যার ফলে স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিপি, নেজামে ইসলামসহ অপরাপর ধর্মভিত্তিক উগ্রসাম্প্রদায়িক দলসমূহ তৎপরতা শুরু করে। পুনর্বাসিত হয় যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। জিয়া কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানান। এই শাহ আজিজুর রহমান ’৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে গিয়ে বলেছিল, পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে অন্যায় কিছু করেনি। স্বাধীনতা নামে সেখানে যা চলছে, তা হলো ভারতের মদদপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের উচিত সেটাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করা। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে গোলাম আজম ঢাকায় আসেন তিন মাসের ভিসা নিয়ে। তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও জিয়া সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গোলাম আজম আড়ালে থেকে জামায়াত দলের কাজ চালিয়ে যান। একসময় গোলাম আজমকে জামায়াতের আমীর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। জিয়া জাতীয় সংসদে যেমন মুক্তিযোদ্ধা আর পাকিস্তানি দালালদের একই আসনে বসান তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রণোদনা স্বরূপ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিকে জিন্দাবাদে পরিণত করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র চালাতে থাকেন। জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। ৪ আগস্ট ১৯৭৬ রাষ্ট্রপতি সায়েম রাজনৈতিক দল গঠনের নীতিমালা (পিপিআর) ঘোষণা করে। ১৪ সেপ্টেম্বর ২৭টি মহকুমায় সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠন করা হতে থাকে। ৪ নভেম্বর তুমুল বিতর্কের মধ্যেই হৃদয়ে এক সাগর রক্তক্ষরণ বহন করেই বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ না করে অনুমোদন নিতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এএসএম সায়েম এক ঘোষণার মাধ্যমে পূর্ব প্রতিশ্রুত ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭-এর নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য হন। ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ সেনাপ্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন। বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট ২৯২ ও ২৯৩ বিধিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য তার চাকরির মেয়াদ শেষ না হতে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সামরিক বাহিনীতে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে চাকরিরত ছিলেন। সুতরাং, ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি ও আইনের বরখেলাপ। সে হিসেবে জিয়াউর রহমান ছিলেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল জিয়াউর রহমান একই সাথে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকার জন্য একটি সামরিক ফরমান জারি করেন। দেশের সংবিধান, আইন-কানুন, সামরিক বাহিনীর বিধি অবৈধভাবে বারবার নিজের স্বার্থে পরিবর্তন এবং জারি করেছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় সামরিক বাহিনীর একটি ক্ষুদ্রাংশের অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের নির্দেশে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কথিত বিচারে সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের ফাঁসি দেওয়া হয়। ২ অক্টোবরের অভ্যুত্থানের অভিযোগে গঠিত ট্রাইব্যুনালের কথিত বিচারে ঢাকায় ১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত এবং কুমিল্লা ২৯ অক্টোবর থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ফাঁসিগুলো কার্যকর করা হয়। এদের মধ্যে ১৯৩ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ শতাধিক সৈনিককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৯৮৭ সালে বিমান বাহিনী থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস’ পুস্তিকার একটি অধ্যায়ে বলা হয়, ঐ ঘটনার পর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ৫৬১ জন বিমানসেনা প্রাণ হারায়। ঐ বইকে পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান এক বেতার ভাষণে বাংলাদেশি জাতীয়বাদের ভিত্তিতে একটি ফ্রন্ট ঘোষণার কথা বলেন। অতঃপর ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি নিজে এই দলের নেতৃত্বে না থাকলেও উপ-রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে এই দল গঠিত হয়। কিন্তু জাগদল সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়ায় জিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে অন্যান্য দলের সমন্বয়ে জাতীয়বাদী ফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৭৮ সালের ২১ এপ্রিল এক ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘোষণা দেয় জিয়াউর রহমান। জিয়া বিরোধী দলগুলোকে মাত্র ৪০ দিনের নোটিশে নির্বাচনে আহ্বান করেন এবং মাত্র ২৩ দিন তাদের প্রচারণার সুযোগ দেন। অন্যদিকে তিনি নিজের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে পুরোপুরি কাজে লাগান। সরকারি মালিকানাধীন টিভি, রেডিও এবং সংবাদপত্রকে একচ্ছত্রভাবে কাজে লাগানো হয়। সর্বোপরি জিয়াউর রহমান একাধারে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ছিলেন। স্বয়ং জিয়া কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ-১৯৭৮ অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে পারবেন না যিনি সরকারি চাকরি করেন এবং এতে বেতন গ্রহণ করতে থাকেন। জিয়া এই অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ১৯৭৮-এর নির্বাচনে দাঁড়িয়ে অবৈধ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে জিয়া জাতীয়বাদী ফ্রন্ট ভেঙে দেন এবং ২৮ আগস্ট নিজের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল (বিএনপি) নামে একটি দল গঠন করেন। তখনও জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান। একজন সেনাপ্রধানের নেতৃত্বেই জন্ম হয় বিএনপির। পরে ১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া এক ফরমান জারি করে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্টের হাতে প্রায় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর নির্বাচনী প্রচারের স্বল্প সুযোগ দিয়ে ১৯৭৯ সালের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। এ সময় আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দল আপত্তি জানায়। আপত্তির মুখে ২৭ জানুয়ারির পরিবর্তে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হয়। জিয়া সরকার নিয়ন্ত্রিত কারচুপির এ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পায় বিএনপি। 

১৯৭৯ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। সংসদ অধিবেশনের প্রথম দিনেই জিয়ার বিএনপি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল উত্থাপন করে। মাত্র তিন দিন সংসদে আলোচনার মধ্য দিয়ে ৫ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনী বিল পাস করে বিএনপি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাযজ্ঞ তদন্ত করতে ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ আইনপ্রণেতা স্যার টমাস উইলিয়ামসের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। ওই কমিশনের প্রতিনিধিরা ঘটনা তদন্তের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইলেও তাদের ভিসা দেয়নি জিয়াউর রহমানের তৎকালীন সরকার। এরপর ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হলে বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে দেশে ফিরতে বাধা দেন জিয়া। সকল বাধা ও হুমকি উপেক্ষা করে ১৯৮১-এর ১৭ মে বঙ্গবন্ধু-কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে ধানমন্ডি বত্রিশস্থ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রবেশ করতে দেননি জিয়াউর রহমান।

জেনারেল জিয়া জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনেরও চেষ্টা করেন।  ধোঁয়া তোলা হয় জাতীয় সংগীত হিন্দুর রচিত গান। প্রেসিডেন্ট জিয়া রাষ্ট্রীয় টাকার বিপুল অপচয় ঘটিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে নানা কৌশলে দুর্বৃত্তায়নের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যেসব সম্পত্তি জাতীয়করণ করেছিলেন, তা জিয়া তাদের ফিরিয়ে দেন। যাদের ফিরিয়ে দিতে পারেন নি তাদের ক্ষতিপূরণ দেন। জিয়া মদ, জুয়া ও পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স প্রদান করে সমাজ নষ্টের বিষবৃক্ষ রোপণ করেন। ১৯৮০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, মুজিব আমলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম যতটুকু এগিয়েছিল, জিয়ার আমল তার কাছাকাছিও যেতে পারেনি। পশ্চিমা ভাষ্যকারদের মত সমর্থন করে ঐ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশ কঠিন অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য দিয়ে ঐ প্রতিবেদনে দেখানো হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত কমতির দিকে।’

এবার নতুন প্রজন্মের কাছে আমার প্রশ্ন, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কে এটা নিয়ে বিতর্ক করার আর কোনো প্রয়োজন আছে কি? বিবেচনার ভার রইল আপনাদের উপর। লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, সকালের সময় 

 

এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া