সন্দ্বীপে বাড়ছে প্রতিবন্ধী: স্কুল ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের দাবি
সন্দ্বীপে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা ও মাতৃসদন হাসপাতাল না থাকার ফলে অদক্ষ ধাত্রী দিয়ে ডেলিভারি করানো,বাল্য বিবাহ, পুষ্টিহীনতা ও গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবতী মায়েদের আঘাত পাওয়া ইত্যাদি কারনে যুগ যুগ ধরে প্রচুর পরিমান প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়েছে এবং হচ্ছে। বর্তমান উন্নয়ন সংগঠন সমূহের তথ্যানুযায়ী সন্দ্বীপে প্রায় দুই সহস্রাধীক প্রতিবন্ধী রয়েছে। সমাজ সেবা অধিদপ্তর কর্তৃক ৬ বছরের নিচের শিশুকে প্রতিবন্ধীর আওতায় আনা হয়না বলে তার প্রকৃত হিসাব মানুষের অজানা থেকে যায়। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে বা প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিবন্ধীতা কাটিয়ে তুলতে উল্লেখ যোগ্য কোন প্রতিষ্ঠান কাজ করছেনা বা প্রতিষ্ঠান নেই বলে পিতা মাতার অবহেলা ও দারিদ্রতার কারনে চিকিৎসাবিহীন অকালে মৃত্যু ঘটে প্রায় প্রতিবন্ধী শিশুদের।তাই প্রতিবন্ধীদের কল্যানে সন্দ্বীপে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলের পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে অভিবাবকের অজ্ঞতা হেতু প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে বা প্রতিবন্ধীতা কাটানোর চেষ্টা না করে তাদের জন্য একটি হুইল চেয়ার কিনে দিয়ে একটি সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়ে দেন বলে মন্তব্য প্রতিবন্ধী বিশ্লেষকদের।
খবর নিয়ে জানা যায় প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে কাজ করার মতো স্বর্নদ্বীপ ফাউন্ডেশন হসপিটাল ছাড়া বিগত দিনে রিকল ২০২১ প্রজেক্ট এসডিআই ব্যাতীত তেমন কোন প্রতিষ্ঠান কাজ করেনি। রিকল প্রজেক্টও ফান্ড ঘাটতির কারনে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৮ মাস হলো। তবে স্বপ্ন ছোঁয়া নামে একটি সামাজিক সংগঠনের নাম দিয়ে কিছু যুবক সিমিত পরিসরে তাদের সাহায্যের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের পকেট থেকে। অন্যদিকে উন্নয়ন কর্মী বাদল রায় স্বাধীনের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে তিনজন মানবিক মানুষ আমেরিকা প্রবাসী মনির চৌধুরী প্রকাশ শিমুল চৌধুরী, সংবাদ কর্মী মোঃ ওমর ফয়সাল, মগধরা ইউপি চেয়ারম্যান এসএম আনোয়ার হোসেন কয়েকজন প্রতিবন্ধীকে গৃহ নির্মান করে দেওয়া সহ জায়গা দান করে দলিল পর্যন্ত হস্তান্তর করেছেন। আর ২/১ টি উন্নয়ন সংস্থা প্রতিবন্ধীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋন প্রদান ও হুইল চেয়ার প্রদান করছে মাঝে মধ্যে।কিন্তু সরাসরি কোন প্রতিষ্ঠান কাজ করেনা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে।অন্যদিকে সরকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজ সেবা অধিদপ্তর প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করলেও সে ভাতা একেবারে নগন্য বলে দাবী করেন প্রতিবন্ধী মাহফুজ। তিনি বলেন প্রতিবন্ধীদের জন্য ৭৫০ টাকা ভাতা তাদের কোন কাজেই আসেনা। এই ভাতা কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা হওয়া উচিত।
স্বর্নদ্বীপ ফাউন্ডেশন পরিদর্শন করে দেখা যায় সেখানে একটি ফিজিও থেরাপী বিভাগ ও একজন কনসালটেন্ট রয়েছেন। সেই ওয়ার্ডে রয়েছে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা সহায়ক অনেকগুলো উপকরন ও যন্ত্রপাতি।দেখা মেলে কয়েকজন প্রতিবন্ধী শিশুর,যাদের অভিবাবকরা নিয়ে এসেছেন সন্তানের প্রতিবন্ধীতা কাটাতে। ভালো পরিবর্তনও আসছে বলে জানালেন তারা।
উক্ত ফাউন্ডেশনে কর্মরত কনসালটেন্ট ফিজিওথেরাপিস্ট ডাঃ মো নাছির উদ্দিন বলেন সেরিব্রাল পালাসিতে আক্রান্ত কম বয়সী ১ থেকে ৭ বছরের শিশুকে সঠিক চিকিৎসা ও চাহিদা অনুযায়ী ডিভাইস দিলে বেশিরভাগ প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সমাজের মূলধারায় ফেরানো সম্ভব। একটা বাচ্চাকে হুইলচেয়ার দেয়ার আগে কর্ণার চেয়ার , মডিফাইড সিটিং চেয়ার, এএফও, কেএএফও, স্ট্যান্ডিং ফ্রেম, ওয়াকার দিয়ে বসা, দাঁড়ানো ও হাঁটা শেখানোর চেষ্টা করানো উচিত। সরাসরি একমাত্র বয়স্ক প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার সাপোর্ট দেওয়া যেতে পারে।
আর সন্দ্বীপের মতো জায়গায় এতো বেশী প্রতিবন্ধী রয়েছে যে এদের জন্য একটি স্কুল স্থাপন খুবই জরুরী। অন্যদিকে সন্দ্বীপের বাইরে চিকিৎসা নেওয়া অনেক ব্যয়বহুল বলে সন্দ্বীপের প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার অভাবে দিন দিন বেড়ে যায়।
অন্যদিকে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এসডিআই'র সহকারী পরিচালক উন্নয়ন আশরাফ হোসেন বলেন, বিগত ৫ বছর ধরে রিকল ২০২১ প্রজেক্ট এসডিআই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বা বড়দের যত্ন নেওয়া ও চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তিতে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি,তাদের জন্য সরকারী বেসরকারী বরাদ্দ প্রাপ্তিতে সহযোগিতা প্রদান, প্রতিবন্ধীদের মানসিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন না করে, মানুষ হিসেবে সন্মান প্রদর্শনের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন উপকরন সহায়তা প্রদান করেছিলো। অন্যদিকে তাদের স্বাবলম্বী করতে এককালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান বিভিন্ন সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি বিশেষ থেকে তাদের জন্য সহযোগিতা এনে দিতে বিশেষ ভুমিকা পালন করে আসছিলো,কিন্তু দাতা সংস্থা অক্সফ্যাম ফান্ড ঘাটতির কারনে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়ায় তারা সে সুবিধাগুলোও এখন পাচ্ছেনা।
উল্লেখ্য সন্দ্বীপ বাংলাদেশের একটি উপজেলা হলেও চারদিকে নদী বেষ্টিত থাকার কারনে এটিকে মুল ভুখন্ড থেকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এটি চট্টগ্রাম জেলার অন্তভুক্ত হলেও কষ্টসাধ্য নৌরুটে যাতায়াত ছাড়া কোন বিকল্প মাধ্যম নেই বলে এটিকে উন্নয়ন বঞ্চিত উপজেলা হিসেবে গন্য করা হয়। সন্দ্বীপের লোকসংখ্যা ৪ লক্ষাধীক হলেও উক্ত এলাকায় স্বাস্থ্য সেবার করুন দশা। দুটি নামে মাত্র সরকারী হসপিটাল থাকলেও চিকিৎসক সংকট ও বিদ্যুৎহীন চিকিৎসা ব্যবস্থা চলছিলো একেবারে নিন্ম পর্যায়ের। মারাত্মক অসুস্থ, রোড এক্সিডেন্টে আহত, হার্ট এটাক ও প্রসব বেদনা উঠলে রোগীদের কোন অপারেশন বা সিজার ব্যবস্থা না থাকা এবং প্যাথলজিক্যাল টেষ্টের ব্যবস্থার অভাবে উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা করতো রুগীর স্বজনেরা। ফলে মুমুর্ষ অবস্থায় চট্টগ্রামে উন্নত চিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগে অনেকে মুত্যু বরন করতো। এছাড়াও অনেক মায়ের পথের মধ্যে বা নদীতে ট্রলার কিংবা জাহাজেও সন্তান প্রসবের মতো করুন ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে ২ টি প্রাইভেট হসপিটাল থাকলেও এগুলোতে প্রতিনিয়ত চিকিৎসক সংকট লেগে থাকে তাই দ্বীপের মানুষ চিকিৎসা সেবার জন্য এখনো চট্টগ্রামের উপর নির্ভরশীল পুরোটা।
এমএসএম / এমএসএম