সহজ কড়চা
নারী কখনো সিনিয়র সিটিজেন হয় না

আগের দু’দিন হাসপাতালে কাটিয়ে গতকাল(৮ মে) প্রায় ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সকালের নাস্তা দেওয়া থেকে শুরু করে রান্না করেছি। নিজেও ওটস আর ব্ল্যাক কফি খেয়েছি। ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুপুরে নানান পদ রেঁধে যখন রান্নাঘর থেকে বের হলাম তখন শরীর নির্গত পানিতেই গোসল করে ফেলেছি। কিন্তু আমাকে বের হতে হবে। অনেক জরুরি কাজ আছে। শাওয়ার নিয়ে যখন বাথরুম থেকে বের হলাম তখন মনে হল ঘুমাই। এতটা ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু না ঘুমালে চলবে না। রেডি হয়ে বাসার বাইরে বের হতেই আগুনের হলকা গায়ে এসে লাগলো। ঘুর্ণিঝড় আসবে বলে সূর্যি মামা মেঘ সাফসুতরো করে প্রবল প্রতাপে তার অগ্নিচক্ষুর হলকা ঢেলে দিচ্ছেন। বিরক্ত হওয়া ছাড়া করার কিছু নেই। চলে গেলাম উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে। সেখানকার কাজ সেরে দিয়াবাড়ি।
গলা ততক্ষণে শুকিয়ে কাঠ। রাস্তায় ডাব খুঁজলাম। নাহ এতোটা পথ ঘুরেও কোথাও ডাব চোখে পড়লো না। বেচারা ডাবওয়ালা তাপমাত্রায় তিষ্ঠোতে পারেনি। যাইহোক সবশেষে এলাম ব্যাংকে। সেখানে বোতলের মুখে পানি খেয়ে গলার খরা কিছুটা কাটলো। সিঁড়ির মুখে একটি মেয়ে সালাম দিল। চিনতে না পারলেও বুঝতে পারলাম ছাত্রী হবে। সে তার পরিচয় দিল এবং জানালো আমাকে সে আইডল মানে। কুলকুল করে ঘামছি। অনেক কথার মাঝে জানালো ব্যাংকের সার্ভার কাজ করছে না। আমি প্রমাদ গুনলাম। ও চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার জরুরি দরকার। ও চলে গেলে আমি উপরে গেলাম। দেখি দীর্ঘ লাইন। আমিও দাঁড়ালাম। সার্ভার কাজ শুরু করেছে। ছাত্রীটি এসে তার কাগজ নিয়ে গেল। পরিচিত কারো কাছে দায়িত্ব দিয়েছিল তার কাজের।
যে জন্য আজ আমার এই লেখা সে কথায় আসি। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম পাশে আরেকটা লাইন যেখানে মাত্র তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। একটু অবাক হলাম! অন্য দুটি লাইন একটি নারীদের অন্যটি পুরুষের। অজগরের মতো এঁকে বেঁকে গেছে। আর ওখানে মাত্র তিনজন। কাহিনি কি? লাইন থেকে বেরিয়ে একজনকে প্রশ্ন করলাম আঙুলের ইশারায়,ওই লাইনে এতো কম লোক কেন? তিনি উত্তর দিলেন, ওটা সিনিয়র সিটিজেনের। আমি বললাম ওহ। তারপর মনে হলো আমিও তো সিনিয়র সিটিজেন। সে কথা তাকে বলায়, সে জানালো ওটা শুধু পুরুষের জন্য। আমি বললাম, তাহলে নারীদের জন্য আরেকটা লাইন করেন। তিনি বললেন, নারীদের জন্য নাই।
এমনিতেই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। দ্বিতীয়বার ঘেমে নেয়ে উঠেছি। আর বলে কি? আমি সিনিয়র সিটিজেনের সারিতে যেয়ে একজনের পেছনে দাঁড়িয়ে কাউন্টারে বললাম, পুরুষ সিনিয়র সিটিজেন হয়ে আলাদা ব্যবস্থা পেতে পারে নারীর জন্য কেন সে ব্যবস্থা নাই? নারীর বয়স কি বাড়ে না? নাকি নারী বলে সিনিয়র সিটিজেনের সম্মানটুকু পাবে না? আমার সামনে দাঁড়ানো তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। একজন বললেন আপনি তো সিনিয়র সিটিজেন নন। আমাকে দেখে তাদের মনে হয়েছে এটা বলে আমি সুবিধা নিতে চাচ্ছি। আমি কারো কথার উত্তর না দিয়ে কাউন্টারের ওপারে বসা ভদ্রলোককে বললাম, কত বয়স হলে নারী সিনিয়র সিটিজেন হবে বলেন? নারীদের লাইনের সকলেই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি আরও বললাম, আমাদের জন্য এই ব্যবস্থা থাকতে হবে। না থাকলে কারো জন্যই থাকবে না। কাউন্টার ওপারের ভদ্রলোক বললেন, ম্যাডাম দিন আপনার পেপারস। আমি দুই মিনিটে কাজ সেরে বেরিয়ে এলাম।
চান্দিগলা রোদে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো নারীদের যে বয়স হয় সে কথা কেউ মনে করে না। না পরিবার, না স্বামী, সন্তান। শুরুতেই যে আমার সকালের বর্ণনা দিয়েছিলাম তা নারীর বয়স হয় না, নারীর গরম বা শীত লাগে না, নারীর বিছানায় না পড়া পর্যন্ত শরীর খারাপ হয় না বোঝাতেই। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন প্রায় সব পরিবারেই বাবা বুড়ো হয়, মা কিন্তু হয় না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও মা সংসারের যথাসাধ্য কাজ করেন। বাবা বসে পেপার পড়েন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন। শরীরে সক্ষমতা থাকলে কখনো সখনো বাজার করেন। চায়ের অভ্যেস থাকলে বার বার স্ত্রীকে চা করতে বলেন। অসুস্থ হলে তো কথাই নাই। বৃদ্ধ বয়সে নারীকে সেবা করতে হয় আরেক বৃদ্ধের। হয়তোবা সেই পুরুষটি সারাজীবন তাকে অবজ্ঞা, অসম্মান, মানসিক নির্যাতন এবং অনেক ক্ষেত্রে শারিরীক নির্যাতন করেছেন। সমস্ত সেবা নিয়ে নারীর প্রতি অসম্মানজনক আচরণ করতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের বাধে না।
কেউ হয়তো বলবেন নারী আয় করে না। নারী আয় করে না কথাটা ঠিক নয়। নারীর কর্মের আর্থিক মূল্যায়ন করা হয় না। নারীর কর্মঘণ্টাকে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। যেসব নারী বাইরে কাজ করে আয় করেন না তাদের কথা বলছি। আর যেসব নারী মাস গেলে বেতন পান তারাও কি সংসারে সুবিধা পান। সাধারণত: যা ঘটে সেই কথা বলছি। অফিসের সমস্ত দায়িত্ব পালন শেষে ঘরে ফিরে তাকে শ্রমের সমস্তটুকুই দিতে হয়। নারী যে তাতে খুব বেশি বিরিক্ত হন তা নয়। কিন্তু তার এই শ্রমের মূল্যায়ন করা হয় না। চাকরি না করলে শুনতে হয়, কি করো সারাদিন? ইনকাম তো করো না, করলে বুঝতে। বসে বসে তো সিরিয়াল দেখো। নারী কিছু করে না। এমনি এমনি ঘরদুয়ার, জামাকাপড় পরিষ্কার থাকে। টেবিলে পছন্দের খাবার পাওয়া যায় তিনবেলা। বাচ্চাদের সুন্দর ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যা প্রয়োজন তার সবটুকু পাওয়া যায়। অন্যদিকে চাকরি করলে, আরে মেয়ে তো বুঝতে পারে না । যেন নারী যেকোনো পদেই কর্মরত থাকুক না কেন সে পদের নির্ধারিত কাজ তাকে করতে হয়, তাই নয়কি? ওই পদে একজন পুরুষ থাকলে যে যে কাজ করতে হতো একজন নারীকে তাই করতে হয়। মজার ব্যাপার কি জানেন পুরুষ যেকোনো বড় পদের নারী কর্মকর্তাকে দেখে বিগলিত হয়। তোয়াজ করতেও কুন্ঠিত হয় না নিজের স্বার্থ উদ্ধারে। সেই পুরুষ নিজের পরিবারে একই পর্যায়ের নারী কর্মকর্তা যদি তার স্ত্রী হয় তাহলে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে একবারও ভাবে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কারণ কি? ওই নারী কর্মকর্তা তার হুকুম তামিল করে। তাকে সর্বোচ্চ স্বাচ্ছন্দ্য দিতে চেষ্টা করে। আর তাই তাকে সম্মান করার কথা পুরুষের মনেই থাকে না।
অন্যদিকে ওই পুরুষ তার প্রতিষ্ঠিত কন্যাকে বা বোনকে নিয়ে কিন্তু গর্ব করে। আচরণ বদলে যায় শুধু স্ত্রী নারীর ক্ষেত্রে। মানে আমাদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যুগ যুগ ধরে তা হচ্ছে সংসারের সবচেয়ে শ্রম দেওয়া নারীর সঙ্গে ইচ্ছেমতো আচরণ করা যায়। আর এটি হয়েছে কিছু ভুল ট্যাবুর কারণে। মেয়েরাও মা, চাচি, খালা, নানি, দাদিকে একই অবস্থানে দেখে বড় হয়। ফলে তার মধ্যেও ধীরে ধীরে একই ধারণার বীজ উপ্ত হয়ে মহীরুহতে পরিণত হয়। ফলে আজকের নারী অনেক কিছুই বুঝতে পারলেও সেই একই ঘানিতে জুতে থাকা নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। তার মনের মধ্যে একটি কথা সবসময় গুনগুনাতে থাকে, পাছে লোকে কিছু বলে। আর তাই বংশপরম্পরায় একই দৃশ্যের ছায়াছবি দেখে যাচ্ছি আমরা কালের পরিক্রমায়।
নারী প্রকৃতিগতভাবেই তার চারপাশের মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে ভালোবাসে। কিন্তু সেটা যখন সকলে নারীর কাছে তাদের প্রাপ্য ভাবে তখনই আপত্তিটা আসে। তবে তা আপত্তিতেই থেকে যায়। সেটার আর সমাধান দেখা যায় না। আর তাই তো নারী হয়েও নারীর কষ্ট আমরা অনেকেই বুঝি না। খুব সহজেই শীতের সকালে লেপের মধ্যে থেকে নারী হয়ে উঠতে থাকা মেয়েটি ৫০ ঊর্ধ্ব বয়সের মাকে বলে, মা চাও দাও। ভাবে না মায়েরও এই শীতের সকালে লেপের উষ্ণতায় এককাপ ধূমায়িত চা পেতে ইচ্ছে করে। কিংবা যে বধূটি দুপুরে বিশ্রাম করবে বলে তার দুরন্ত বাচ্চাটিকে শাশুড়ির কাছে পাঠিয়ে ভাতঘুম দেয়, সেও ভাবে না ওই নারী একাধিক বাচ্চা মানুষ করেছেন নিজের সবটুকু শ্রম দিয়ে। তার এখন বিশ্রাম দরকার এই তপ্ত দুপুরে। শুধু যে ছেলের বউ করে তা নয় মেয়েরাও করে। দাদি বা নানি নাতি-নাতনির জন্য করবেনই কিন্তু সেটা যদি দাবির পর্যায়ে পড়ে তবে তা ঠিক নয়। এক্ষেত্রেও কিন্তু নারীকেই ভার নিতে হয়, পুরুষকে নয় ।
আসলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউই নারীকে সিনিয়র সিটিজেন ভাবতে চায় না। তাইতো মাঝে মাঝেই পত্রিকার পাতায় দেখি, আর কত বয়স হলে ওমুকে বয়স্কভাতা পাবেন। আসলে সব কর্মকাণ্ডে তো আমরা আমরাই। ফলে ঘরের বাইরে নারীর জন্য অনেক কথা বললেও ঘরে তার তিল পরিমাণ আচরণে আনতে পারি না। ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর থেকে যায়। আর তাই নারী সমাজের যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই করুক না কেন তার অবসর নেওয়া হয় না। কর্মক্ষেত্র থেকে পেলেও সংসার তাকে অবসর দেয় না মৃত্যু পর্যন্ত।
তাইতো সকালে হাঁটতে গেলে দেখি রাস্তা দিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলা বাজার করে ঘরে ফিরছেন। আর অবসর যদি না পায় তাহলে সিনিয়র সিটিজেন হবে কি করে? আর তাই নারী হয়ে উঠতে থাকা মেয়েটি খুব সহজেই বয়স্ক মায়ের কাছে চায়ের উত্তাপটুকু পেতে চায়। সে বুঝতেও পারে না সামনে তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন সত্য। তা হচ্ছে, নারী কখনো সিনিয়র সিটিজেন হয় না। তার থেকেও প্রকৃতি সবটুকু নিংড়ে নেবে।
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ
গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
