জামায়াতের সমাবেশ কি মার্কিন ভিসা নীতির ফল?

আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক অনেকটা সাপে-নেউলের মতো। সুযোগ পেলেই যেন একে অপরকে আক্রমণ করে বসে। আর এর মূল কারণ হলো মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল হলো আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে জামায়াত ছিল স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। তারা চেয়েছিল অখন্ড পাকিস্তান। তারা এ দেশে পাকিস্তানি সেনাদের দোসর ছিল। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং আমাদের মা-বোনদের তারা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিত। তারা ধর্ষণ শেষে তাদের হত্যা করতো। তারা দেশে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের অনেক নেতা আত্মগোপনে গিয়েছিল। গ্রেফতারও হয়েছিল অনেকে। তাদের নেতা গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে ঘাতকদের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হওয়ার পর রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়। এক পর্যায়ে ক্ষমতা দখল করেন মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন এবং নাগরিকত্ব দেন। এর মধ্যদিয়েই বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়। পরবর্তীতে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আরেক সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া সেই বৃক্ষে পানি ও সার দেন। ফলশ্রুতিতে মহীরূহে পরিণত হয় জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিকভাবে যেমন দলটি শক্তিশালী হয়; তেমনি এগিয়ে যায় অর্থনৈতিকভাবে। তাদের নেতারা এমপি নির্বাচিত হন। নানা কর্মসূচি আর ধর্মের লেবাস নিয়ে তারা সাধারণ মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেন। সবশেষ বিএনপির সঙ্গে জোট করে তাদের দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ মন্ত্রী হন। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও তারা ১৯৭১ সালের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করার পর ধীরে ধীরে জামায়াতে ইসলামী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতারা সব সময় বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার আহ্বান জানায়। প্রথম দিকে বিএনপি এতে সাড়া দেয়নি। পরে বিএনপির তৃণমূল এবং তাদের দলে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও জামায়াতকে বর্জন করার জোরালো দাবি তোলেন। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বের হয়ে যায় জামায়াত। তখনো দলটির অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করতেন, আসলে জামায়াত বিএনপির সঙ্গেই আছে। গোপনে তারা এক আর প্রকাশ্যে ভিন্ন। এবার আসা যাক জামায়াতের অপরাধ সম্পর্কে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, কাদের মোলা, কামারুজ্জামানসহ কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। একই অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে দলটির আরেক নেতা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর। অনেকে মানবতাবিরোধী অপরাধে কারাগারে আছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে জামায়াত মাঠে নামতে পারেনি বললেই চলে। তারা কখনো প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করতে পারেনি। উপরন্তু তারা ঝটিকা মিছিল করেছে। গোপন সভা করার সময় তাদের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। সেই জামায়াত হঠাৎ পুলিশের কাছে আবেদন করে সমাবেশ করার জন্য। সে সময় পুলিশ তাদের আটক করে এবং পরে মামলা না থাকায় ছেড়ে দেয়। নানা নাটকীয়তার পর তাদের সমাবেশ করার মৌখিক অনুমতি দেয় পুলিশ। শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে তারা সমাবেশ করে। এরপর থেকেই শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। সরকারের সাথে জামায়াতের ‘সমঝোতা’ হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। তবে এ দাবি নাকচ করে সরকারের চারজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেন, জামায়াত এখনো নিষিদ্ধ দল নয়। তাদের বিচার চলছে। সুতরাং নিষিদ্ধ না হলে সমাবেশ করায় দোষ নেই। ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে’ জামায়াতে ইসলামীকে ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের একজন ড. আব্দুর রাজ্জাক। তবে এই সিদ্ধান্তের কারণ তিনি প্রকাশ করেননি। তিনি বলেন, তারা (জামায়াত) রাজনৈতিক দল, হাই কোর্টের রায় ছিল সংবিধানের সঙ্গে তাদের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক, গ্রহণযোগ্য না। এই প্রেক্ষিতেও তাদের তো অনেক জনগণের সমর্থন আছে। এই পরিস্থিতির আলোকে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। আপনারা একটু অপেক্ষা করেন, আরও দেখবেন কী হয়? আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। রাজনৈতিক কারণে, দেখা যাক। এটা একটা পলিটিক্যাল ডিসিশন, এটি সময়ই আমাদের বলে দেবে। ‘রাজনীতিতে অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেক প্রতিকূলতার মাঝে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সুপরিকল্পিতভাবে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধংস করার জন্য, দেশটিকে পাকিস্তানের ধারায় নেওয়ার জন্য অনেক কিছু করেছে। এদেশে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়া যায়নি, বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে আনা যায়নি। এমন পরিস্থিতি ছিল যে সামরিক স্বৈরাচাররা এরশাদের আমলে, জিয়ার আমলে এগুলো করেছে। তখন আমাদের পরিস্থিতির আলোকে অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। সেটিই আমি বলতে চেয়েছি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইনটি (সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করার জন্য আইন সংশোধন) কেবিনেটে কিছু দিনের মধ্যে যাবে। জামায়াতকে দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধে বিচার করার জন্য আইন সংশোধন করার কথা আমি আগে বলেছি, সেই প্রক্রিয়া চলমান। সংশোধনের জন্য যে আইন সেটি কেবিনেটে কিছু দিনের মধ্যে যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই (সমাবেশের) অনুমতি দিয়ে থাকে। উনারা কী বিবেচনায় দিয়েছেন আমার মনে হয় যে, এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষকে আপনারা যদি প্রশ্ন করে সেটা বেটার হবে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বিচার করার পরে যতক্ষণ পর্যন্ত রায় না হয়, দোষী সাব্যস্ত না করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তো আমি বলতে পারব না যে জামায়াত দোষী। বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং বিচারের প্রক্রিয়ায় আমি আজকেই বলব না যে কী হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, জামায়াত একটি অনিবন্ধিত দল। দলটি অনুষ্ঠান করতে মাঠের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু সরকার অনুমতি দেয়নি। দলটি আবদ্ধ স্থানে ইনডোরে মিটিং করতে চেয়েছে, তারা তা দেননি। পরে মৌখিকভাবে কমিশনার (ডিএমপির) অনুমতি দিয়েছেন। এতে আওয়ামী লীগের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সমাবেশ করতেই পারে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কোনো রাজনৈতিক দল সমাবেশ করতেই পারে। জামায়াত তো আর নিষিদ্ধ দল নয়। মন্ত্রীদের কথার সূত্রে বলতে হয়, জামায়াত নিষিদ্ধ দল নয়। এ কারণে তারা সমাবেশ করার সুযোগ পেয়েছে। এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমারও আপত্তি নেই। কিন্তু কথা হলো ২০১৩ সালের পর থেকে দলটি তো প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করতে পারিনি। তাহলে এতদিন, এত বছর কেন তাদের রাজনীতিক অধিকার হরন করা হলো? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? আরেকটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর সরকার অনেক বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। যেহুতু দলটি নিষিদ্ধ নয়, সে কারণে তারা সমাবেশ করার আবেদন করে। নানা পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। কেননা, তারা অনুমতি না পেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বলতো ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ নেই। সভা-সমাবেশ করা যাচ্ছে না।’ লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
