সুতোয় বাঁধা জীবন

দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়া থাকায় যেতে পারিনি পাহাড়ে। দেশে ফিরে আসার পর একদিন ভিডিও কলে পাহাড়ের প্রান্তিক নারীদের কাজ দেখলাম, কথা বললাম। ওরা বার বার জানতে চাইলো আমি কবে যাব ওদের ওখানে। যেতে চাইছি কিন্তু কবে যাই ঠিক করতে পারছিলাম না। আসার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। দেখতে দেখতে একটা মাস কেটে গেল। ঠিক করলাম এবার যেতেই হবে। যাদের কাপড় বুননের উপকরণ দেব তাদের বলা হয়েছে। সবুজ ও বীণাদি মিলে প্রস্তুতি নিয়েছে শুধু আমার যাওয়ার অপেক্ষা। এদিকে প্রচন্ড কাশিতে অস্থির। যাইহোক গতবছর ১৫ ডিসেম্বর গাড়িতে উঠে পড়লাম। সামনের দিকে টিকেট না পাওয়ায় সমস্যা হয়ে গেল। তারপর আবার গাড়ি ছাড়তে অনেক দেরি করলো। ঢাকায় ততক্ষণে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত রাত প্রায় দুইটার দিকে গাড়ি চলতে শুরু করলো। জ্যাম ঠেলে সকাল আটটার দিকে গন্তব্যে পৌঁছলো। গাইরিং হোটেলে যখন নামলাম তখন সমস্ত শহর কুয়াশার চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে রেখেছে।
হোটেলের চেহারা পাল্টেছে। নতুন সংযোজন লিফট। আমাকে পাঁচতলায় রুম দেয়া হয়েছে। উঠে গেলাম লিফটে। রুমে গিয়ে দেখি ঘড়ির কাঁটা ৯টার ঘরে। বিছানা টানলেও সময় নাই। তাই শাওয়ার নিয়ে নাস্তা সেরে পথে নামলাম। ততক্ষণে সবুজ এসে গেছে। চলে আসলাম চেঙ্গি নদীর তীরে।
নদীতে নতুন কাঠের সাঁকো হয়েছে। নিস্তরঙ্গ চেঙ্গি বয়ে যাচ্ছে আপন মনে। অনেক নারী বসে আছে আমার অপেক্ষায়। তারা আমার হাত ধরবে বলে পাহাড় ডিঙিয়ে, তিন পাহাড়ের ৫৩ জন নারী অপেক্ষা করছে যাদের জীবন বাঁধা সুতোর বুনটে। তাদের আত্মীয়-পরিজন, বাচ্চা-কাচ্চা সব মিলিয়ে চেংগীর তীর বর্ণিল হয়ে উঠেছে। আরো এসেছে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার জেলা প্রতিনিধিগণ। নিজেকে কেন জানি অপরাধী মনে হচ্ছিল। এই মানুষগুলোর সবার চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা আমার নেই। এটা আমার সীমাবদ্ধতা।
বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে সারা দেশে। আসার পথে মিছিল ফেস্টুন দেখে এসেছি। উৎসবের রঙ চারিদিকে। বিজয় দিবসে আসতে পেরে রাতে পথের কষ্ট ভুলে গেলাম। মনে হলো আজ আমি সবচেয়ে সুন্দর বিজয় দিবস উদযাপন করছি। কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন কুট কুট করে কামড় দিচ্ছে। মনে হচ্ছে স্বাধীনতা যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যের দিকে পা বাড়িয়েছে। চেঙ্গি নদীতে এত জল প্রবাহিত হলেও এই নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নারীদের ভাগ্য কতটা পরিবর্তন হয়েছে? এখনো তাদের পেটের ভাত জোগাতে করতে হয় হাড়ভাঙা পরিশ্রম। তবুও তারা পরিবারের সদস্যদের পেট ভরাতে পারে না। যদিও তাদের চাহিদা আমাদের মত নারীদের চেয়ে অনেক কম। তাদের জন্মগত পেশা কোমর তাঁতের উপকরণ অর্থাৎ সুতা যোগাড় করতে দাদন নিতে হয়। ফলে পরিশ্রমের পুরো অর্থ তাদের হাতে আসে না। এমনিতেই পাহাড় এখনো দূর্গম। শহরের উপকন্ঠে বা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাবার জন্য রাস্তা হয়েছে কিন্তু তা শুধু কিছুটা এগিয়ে দেয়ার জন্য। পাহাড়ে তাদের বসবাস। চড়াই-উৎরাই তাদের নিত্যসঙ্গী। পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পেরোতে পারলেও জীবনের চড়াই-উৎরাই এই নারীদের সামনে হিমালয়ের মত দাঁড়িয়ে আছে।
এই নারীদের দিকে তাকালে বহু বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। পাহাড়ি নারীরা সদ্য যৌবনে পা দেয়া আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। সেই আলোড়নের মধ্যে সুক্ষ্ম ব্যথা লুকিয়ে ছিল। এরপর দেশে এবং দেশের বাইরে যতবারই পাহাড়ে গিয়েছি ততবারই রাঙামাটি, বিলাইছড়ী , বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ি নারীর মুখ মনের কোণে উঁকি দিয়েছে। মনে মনে ছিল যদি কোনোদিন সুযোগ পাই তাহলে এদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব। করোনাকাল শেষ হলে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি নারীদের দিকে হাত বাড়ালাম।
শুরু হলো পাকদণ্ডি বেয়ে পথ চলা। পথের মাঝে এসে দেখলাম অনমনীয় সংগ্রামী নারীর নতুন রুপ। প্রকৃতি তাকে কতটা সর্বংসহা করেছে। শুকিয়ে যাওয়া ঝিরি থেকে আঁজলা ভরে পানি পান করতে তাদের কতটা হাঁটতে হয়। পিপাসিত শিশুর মুখে এক গুন্ডুস পানি দিতে নারী বালি খুঁড়ে পানি জমায়। সেই ফোঁটা ফোঁটা পানিতে পিপাসা তাদের কতটুকু মেটে আমার জানা নেই। কত কিছুই তো আমি বা আমরা জানি না। পাহাড় দেখে আমার মুগ্ধ হই। পর্যটনের সাথে জড়িয়ে থাকা ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের সেবা দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে। কিন্তু যাদের আবাসভূমি দেখিয়ে ব্যবসা করে ভাগ্যের চাকা ঘুরায়, তাদের ভাগ্যের চাকা কিন্তু স্থবির থাকে। বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদের। সবখানেই প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন তেমন হয় না। সবকিছুই আমাকে প্রভাবিত করে পাহাড়ে সাধ্যের মধ্যে কাজ করার জন্য।
নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই শুরু করি। একে একে চর্থুতবারের মতো ৫৩ জন নারীর হাতে তুলে দিলাম উপকরণ। এইসব নারীদের কষ্টের কথা শুনলাম মন দিয়ে। তারপর সাঁকো পেরিয়ে চলে গেলাম আরো উচুঁতে চ্যালো পাড়া। সেখানে বুনন দেখে ফিরেতে হলো সময়কে পেছনে ফেলে।
পাহাড়ের এই জনপদের নারীরা তাদের জীবন বেঁধে নিয়েছে সুতোর বুনটে। সুখ-দুঃখ , হাসি-কান্না সব আবর্তিত হয় তাঁতের সুতোয়। তাদের চোখে স্বপ্ন দেখেছি নতুন দিনের। সেই স্বপ্ন আমাকে তাড়িত করবে আবারো চেঙ্গি নদীর স্রোত ধারায়। আবার আসবো কোনো কাক ডাকা ভোরে।
আবার গিয়েছি। আবারও অর্ধশতাধিক নারীর হাত ধরেছি অন্য এক পাহাড়ি গ্রামে। মে মাসের সূর্যগলা রোদে বসে থাকা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে ভুগেছি। মনে হয়েছে এই সামান্য সুতোর জন্য এতটা কষ্ট! পাশাপাশি একটুখানি স্বস্তি যে ১৬৫ জন প্রান্তিক পাহাড়ি নারীর হাত ধরতে পেরেছি। তাদের কোমর তাঁতে আবার ছন্দ ফিরেছে। রঙিন সুতোয় বুনে চলেছে আগামীর স্বপ্ন। ছোট্ট শিশুর হাসিতে মুখরিত উঠোন। শুকুর ছানার সাথে দেবশিশুর অনবদ্য চালচিত্র। গাছগাছালির ফাঁক গলে রোদ এসে ঠোঁট রাখে নাম না জানা ফুলে। অপরাজিতা দোল খায় বাঁশের বেড়ায়। আমি ক্লান্ত হয়ে মুগ্ধ চোখে দেখি দূর পাহাড়ের টিনের চালে রোদের ঝিলিক। সময় আমায় ফিরতি পথে ডাকে । ফিরে চলি।
আগামীকাল মাটিরাঙা যাব। সেখানে অপেক্ষা করেছে আরো কিছু প্রান্তিক নারী। যাবার প্রস্তুতি নিয়ে কংলাক ছুঁয়ে আসা বাতাসের আর্তচিৎকার শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম। পাহাড়ে ঝরে পড়ছে শুকনো পাতা টুপটাপ।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ
গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
