ঢাকা শনিবার, ২ আগস্ট, ২০২৫

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ইন্টারনেট এডিকশন


রায়হান আহমেদ তপাদার  photo রায়হান আহমেদ তপাদার
প্রকাশিত: ১৭-৭-২০২৩ দুপুর ১২:৫২

আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগেও কম্পিউটার নিয়ে যারা বেশির ভাগ সময় কাটাতেন তাঁরা ছিলেন প্রধানত তথ্য প্রযুক্তির লোক এবং সেই সময়টুকুর জন্য তাদেরকে বেতন-ভাতা দেওয়া হত।ইন্টারনেটের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কম্পিউটার নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটায় এবং সেই সময়টুকুর জন্য নিজেরাই মুল্য পরিশোধ করে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আজ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই ইন্টারনেটের এ যুগে সবাই কোনো না কোনোভাবে নানা প্রয়োজনে ব্যবহার করে। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বহুল উচ্চারিত কতগুলো শব্দের মধ্যে অতি পরিচিত দুটি শব্দ হচ্ছে ইন্টারনেট এডিকশন। এর সঙ্গে আরও কতগুলো শব্দ চলে আসে যেমন-ফেসবুক এডিকশন, মোবাইল এডিকশন, ইন্টারনেট গেমিং এডিকশন ইত্যাদি। এডিকশনকে সংজ্ঞায়িত করা হয় মস্তিষ্কের তথা মনের একটি ব্যাধিরূপে। এ কথা আমরা সবাই কম বেশি জানি যে, মন থাকে মাথায় তথা মস্তিষ্কে। ইন্টারনেট আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ইন্টারনেটের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। বিভিন্ন উদ্দেশ্যেই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ দিনরাত ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। কিন্ত আমরা হয়তোবা বুঝতেই পারি না যে, ইন্টারনেট ব্যবহার করা কেবল আমাদের অভ্যাস নয়, একটি আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই আসক্তির কারণেই আমরা সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে মানসিক ব্যাধির অত্যাধিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করি। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা, যা জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শুধু ইন্টারনেট আসক্তি নয়, ইন্টারনেট গেমিং ডিসঅর্ডার (আইজিডি) আমাদের মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অত্যধিক ইন্টারনেট ব্যবহার অনেক মানসিক এবং মনোসামাজিক ব্যাধির সাথে সম্পর্কিত। এতে আমাদের শিক্ষার্থী সমাজ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানসিকভাবে অসুস্থ শিক্ষার্থীদের ৮৬ শতাংশই শুধু অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। এবং ৭২.২ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৩৮.২ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বিষয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ৬৭.৫ শতাংশ অবসর সময় কাটাতে, ৪২.৯ শতাংশ যোগাযোগের প্রয়োজনে, ২৪.৯ শতাংশ অনলাইন গেম খেলতে বা ভিডিও দেখতে, ১২.৬ শতাংশ অনলাইনে কেনাকাটা করতে এবং ৮ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। সমীক্ষা মোতাবেক, আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই অফলপ্রসূ কাজে ইন্টারনেটে বেশি সময় ব্যয় করে। সুতরাং এটি খুবই স্পষ্ট যে, ইন্টারনেট আসক্তিতে শিক্ষার্থীরা এত বেশি বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে যে, তাদের অধিকাংশই এখন নানাবিধ মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমাদের শিক্ষার্থীরা মনের অজান্তে কীভাবে ইন্টারনেট আসক্তিতে পড়ছে, তা আমরা বুঝতেই পারছি না। ইন্টারনেট আসক্তিতে মানসিক ব্যাধি সৃষ্টির অনেক কারণ রয়েছে। যখন কারোর ইন্টারনেট আসক্তি থাকে, তখন তার মস্তিষ্ক এমনভাবে কাজ শুরু করে যেন একজন আসক্তের মস্তিষ্ক কাজ করছে। ইন্টারনেট নির্ভরতা নেশাজাতীয় ড্রাগ নির্ভরতার থেকেও মারাত্মক। এটি শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। ফলে তাদের জন্য বিশদ মনে রাখা, পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফোকাস করা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আসক্তিমূলক আচরণ ডোপামাইন নিঃসরণকে এমনভাবে ট্রিগার করে যেন তারা একরকম আনন্দ পেতে এর থেকে আরও বেশি ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। ইন্টারনেট আসক্তিতে শিক্ষার্থীদের পরিবর্তনশীল আচরণের শক্তি বৃদ্ধি পায়। 

ফলে তারা ইন্টারনেট ভিত্তিক গেম, কেনাকাটা বা জুয়া খেলায় মত্ত হয়ে উঠছে এবং এক পর্যায়ে তারা এ থেকে ভারচুয়াল পুরস্কারও জিতে নিচ্ছে। এ আসক্তির কারণে তারা এতটাই সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় ব্যয় করছে যে, তারা সর্বক্ষণই বন্ধুদের সাথে আড্ডায় লিপ্ত থাকছে। ইন্টারনেট নির্ভরতায় শিক্ষার্থীদের জৈবিক প্রবণতা আরো শক্তিশালী হয়। এতে তাদের ডোপামিন ও সেরোটোনিনের নিম্ন মাত্রার প্রভাব থাকে, যার জন্য তাদেরকে আরো আনন্দ পেতে শক্তি জোগায় এবং আচরণিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে। যদি কোন শিক্ষার্থী উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতায় জীবনযাপন করে, তাহলে তার মধ্যে যথেষ্ট অসামাজিক আচরণের সম্ভাবনা থাকে, তার একাকিত্ব ভালো লাগে কিংবা তার মধ্যে ঔদাসন্য প্রকাশ পায়। ফলে সে তার একাকিত্ব ও উদাসীনতা কাটাতে ইন্টারনেট নির্ভর কাজে যুক্ত থাকতে বেশি পছন্দ করে। বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হলেও সত্য যে, আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে, প্রায় সকল শিক্ষার্থীই তাদের ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে বা সেটি নিয়েই তারা বেশি ব্যস্ত থাকছে। এতে বুঝা যায় যে, তাদের অধিকাংশই ইন্টারনেট এডিকশন ডিসঅর্ডারে ভুগছে। এছাড়াও ইন্টারনেট আসক্তির কারণে যেমন মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি রয়েছে,তেমনি শারীরিক স্বাস্থ্যেরও অনেক ঝুঁকি রয়েছে। ইন্টারনেট নির্ভর লেখাপড়ার অজুহাতে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।তথ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষকগণ মনে করেন যে, আমাদের দেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রডাক্টগুলো মানুষকে আসক্ত করতেই তৈরি হয়। ফেসবুক চায় সারাক্ষণ এটা মানুষ ব্যবহার করুক। কারণ, এটা তাদের ব্যবসা। ইন্সটাগ্রাম চায়, সারাক্ষণ মানুষ ছবি ও ভিডিও আপলোড করুক। লিংকড-ইন চায়, শিক্ষিতরা সারাদিন ক্যারিয়ারের সন্ধানে সময় ব্যয় করুক। তাহলে তাদের ব্যবসা বাড়বে এবং মানুষকে আসক্ত করতে তারা এতোদ্দেশ্যে অর্থ বিনিয়োগ করে গবেষণা করে।

ইন্টারনেট আসক্তির মারাত্মক প্রভাব আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে যে ক্ষতি সাধন করছে, তাতে এর প্রতিকার নাহলে অচিরেই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। তাছাড়া শারীরিক কার্যকলাপ ইন্টারনেট আসক্তির চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য অবশ্যই ধ্যান-জ্ঞান করে রুটিন মাফিক বিষয় ভিত্তিক বই-পুস্তক পড়াশোনা করতে হবে, লাইব্রেরিতে বই পড়ার কাজে সময় দিতে হবে, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সাথে বেশি সময় কাটাতে হবে, ইনডোর বা আউটডোর ক্রীড়াঙ্গনে নিয়মিত খেলা করতে হবে এবং শ্রেণি কার্যক্রম সহ অন্যান্য সহপাঠ্যক্রমিক কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ইন্টারনেটের বিকল্প হিসেবে বিনোদনধর্মী কিছু গল্প বা উপন্যাস পড়লেও ইন্টারনেট আসক্তি রোধ করা সম্ভব হতে পারে। তথ্য-প্রযুক্তিবীদগণ পরামর্শ দিয়েছেন এভাবে, ইন্টারনেট ছাড়া যেহেতু প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়, সেহেতু ইন্টারনেট ব্যবহার করার শুরুতেই শিক্ষার্থীদের এর সকল দিক সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কারণ, ইন্টারনেট ছাড়াতো আমরা চলতে পারব না। তাই এর ভালো ও খারাপ দিক সম্পর্কে খোলাখুলি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই যে শিক্ষার্থীরা খারাপ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। এটা আমাদের প্রয়োজন। তাই দরকার ইন্টারনেট লিটারেসি। এটা পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সবার কাজ। আরেকটি বিষয় আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করছি এবং আমরা প্রযুক্তি দ্বারা বেষ্টিত। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা প্রলোভনে পড়বে, এটা স্বাভাবিক। কিন্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটু সময়ও যেন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্ত রাখতে বা এর অতি ব্যবহার রোধ করতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। 

ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের শারীরিক, সামাজিক এবং মানসিক ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে, এটি মাথায় রেখেই আমাদের উচিত তাদেরকে সার্বক্ষণিক কাউন্সেলিং করা এবং উপদেশের মাধ্যমে ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করে ইন্টারনেট নির্ভরতা কমানো। ইন্টারনেটের সুফল ও ইতিবাচক দিক অনেক যা এখানে লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু সেই সুফল পেতে যেন ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং কর্মজীবনে নতুন কোন সমস্যার সৃষ্টি না হয় আমাদেরকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। ইন্টারনেটের ভালো দিকগুলো যেমন আমাদের জীবনকে আরো সহজ ও গতিময় করতে পারে, তেমনি এর খারাপ দিকগুলো আমাদের জীবনকে করতে পারে আরো জটিল ও বেদনাময়। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার এইসব দিনরাত্রি নিয়ে আমাদের জীবন। সব দুঃখ-কষ্টকে সবাই একইভাবে মোকাবেলা করতে পারে না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাগত জীবনে সমস্যা আসতে পারে। অনেকে এইসব দুঃখ-কষ্ট ও সমস্যাকে ভুলে থাকার জন্য ইন্টারনেটকে বিকল্প হিসেবে বেছে নেয়। এভাবে বাস্তব জীবনের সমস্যাকে ভুলতে গিয়ে আরও একটি সমস্যায় পতিত হয়, যার নাম ইন্টারনেট আসক্তি। সুতরাং শুরু থেকেই সাবধান। নতুন যে কোন কিছুতেই শুরুর দিকে মানুষের ব্যাপক কৌতুহল-উদ্দীপনা থাকে। একটা সময়ে এসে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। ইন্টারনেটও এর ব্যতিক্রম নয়। পরিশেষে বলব, ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, ইচ্ছা, চেষ্টা এবং পারষ্পরিক সহযোগিতা। ইন্টারনেট আমাদের সার্বিক জীবনে অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হউক এটাই সবার প্রত্যাশা।

এমএসএম / এমএসএম

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া

মানবিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস ২০২৫ : গল্পের মাধ্যমে গড়ে উঠুক সচেতনতার বাঁধ

রাজনীতি আজ নিলামের হাট: কুষ্টিয়া-৪ এ হাইব্রিড দাপটের নির্মম প্রতিচ্ছবি

জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দিবে প্রবাসীরা, আনন্দে ভাসছে পরবাসে বাঙালীরা

বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা ও বাংলাদেশে তার প্রভাব

বাংলাদেশে ওয়াশিং প্ল্যান্টের বর্জ্য দ্বারা মিঠাপানির দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে

বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ

দলীয় পরিচয়ে পদোন্নতি ও বদলি: দুর্নীতির ভয়াল থাবায় বাংলাদেশ

ব্যবসায়ীদের জন্য ওয়ান-স্টপ সমাধান: FBCCI-এর বিদ্যমান সেবার উৎকর্ষ সাধন

বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিসরকে একীভূত করা: অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য বিসিক কেন অপরিহার্য

সবুজ অর্থায়নের কৌশলগত বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগ