ফ্রি-ফায়ার, পাবজি, টিকটক, লাইকিতে-কোন পথে এগোচ্ছে শিক্ষার্থীরা?

করোনা মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ প্রায় ১৭ মাস। শিক্ষার্থীদের সময় কাটছে ঘরে বসে, মোবাইলে গেইমস খেলে, আর লাইকি, টিকটক এর ভিডিও দেখে। বলতে গেলে এই দেড় বছরে মোবাইল ফোনের প্রতি মারাত্নকভাবে আশক্ত হয়ে পড়েছে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দক্ষিণ কোরিয়ার ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ব্লু হোয়েলের তৈরি করা অনলাইন ভিডিও গেম প্লেয়ার আননোনস ব্যাটেলগ্রাউন্ডস (পাবজি)।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় গেমগুলোর মধ্যে অন্যতম পাবজি। ইন্টারনেটের কারণে এই গেমটির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। গেম নির্মাতা কোম্পানি ব্লু হোয়েল ২০১৮ সালে অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস অপারেটিং সিস্টেমের জন্য বাজারে আনা হয় পাবজি মোবাইল। গেমটি ব্লুহোয়েলের পূর্ববর্তী আর একটি গেম ‘প্লেয়ার আননোন’র সিক্যুয়েল ও বলা চলে। তবে পাবজির ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। বাংলাদেশে বন্ধ করে দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই আবার খুলে দেওয়া হয়েছে পাবজি গেমটি।
এর আগে গেমটির মাধ্যমে তরুণেরা সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ হতে পারে আশঙ্কায় গেমটি বন্ধ করা হয়েছিল। ১৩ বছরের কম বয়সীদের জন্য এই গেমটি নিষিদ্ধ। তবে বিভিন্ন সংস্থা পরামর্শ দিয়েছে এই গেমটি খেলার সর্বনিম্ন বয়স ১৭ বছর হওয়া উচিত। অতিরিক্ত হিংস্রতা শিশু-কিশোরদের মধ্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরবর্তী জীবনে শিশুদের হিংসৃ করে তুলতে পারে গেমটি। পাবজি শুধু হিংস্রই করে তোলে না, একইসঙ্গে শারীরিক সক্ষমতার ওপরে বাজে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণার পর জানিয়েছে ভিডিও গেমে আসক্তি এক ধরনের মানসিক রোগ।
ভিডিও গেমগুলো একজন খেলোয়াড়ের ডিপ্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অপরদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেক আতংকের নাম টিকটক, লাইকি। বিনোদনের পরিবর্তে যেটি বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয়ের কারন হিসেবে দাঁড়িয়েছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভিডিওতে নিজের ব্যাঙ্গাত্মক মুখভঙ্গি কিংবা রোম্য সংলাপের ঠোঁট মেলানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে তরুন প্রজন্ম। সমাজের একটি বৃহৎ অংশ টিকটক, লাইকির অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব অ্যাপসের করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসা অতীব জরুরী।
টিকটক অ্যাপটির যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালে চীনে। টিকটকের প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়েমিং। চীনে এটি ডুইয়িন নামেও পরিচিত। যার আক্ষরিক অর্থ হলো গলা কম্পন ছোট ভিডিও। এর শ্লোগান হলো তোমার দিন বানাও : আসল মানুষ, আসল ভিডিও (মেক ইওর ডে: রিয়েল পিপল, রিয়েল ভিডিও) বর্তমানে টিকটক এশিয়ার নেতৃত্ব স্থানীয় ছোট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম এবং বিশ্বব্যাপি সবচেয়ে বড় সংগীত ভিডিও সম্প্রদায় হিসেবে বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অ্যাপ্লিকেশন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। শুরুর দিকে ৫,১০,১৫ সেকেন্ডের ভিডিও দিতে পারতো তবে এখন আড়াই মিনিট পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের ভিডিও দেওয়া যায়। ২০১৮ সালে আনুমানিক ডাউনলোড করা হয় ৪৫.৮ মিলিওনেরও বেশি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১০০ কোটিবার ডাউনলোড হয় টিকটক। ২০২০ এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত আইওএস অপারেটিং সিস্টেমে ২৩৩ কোটি টিকটক নামানো হয়। এ বছরে ডাইনলোডের সংখ্যা গুগল, ইউটিউব ইনস্টাগ্রাম অ্যাপকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ৩ মাসে ৩১ কোটি ৫০ লাখবার ডাউনলোড করা হয়। ১৫৫ টি দেশের ৪০ টি ভাষায় চলে এটি। বর্তমানে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮০ কোটিরও অধিক (উইকিপিডিয়া)।
তবে টিকটকের তুলনায় আরেক আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে লাইকি। লাইকি হলো ছোট ভিডিও নির্মাণ এবং ভাগ করে নেওয়ার প্ল্যাটফর্ম। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংস্থা বিগো কর্তৃক চালু করা হয় এটি। লাইকি ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বাজারে আসে। এর নাম আগে ছিলো লাইক। এখন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে লাইকি। ৩৭টি ভাষায় লাইকি চলে। বর্তমানে লাইকির সক্রিয় ব্যবহারকারী সাড়ে ১১ কোটি। (উইকিপিডিয়া)
অ্যাপ দুটির জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে সহজলভ্যতা এবং 'তথাকথিত' তারকা খ্যাতি লাভের প্রত্যাশা। একটি স্মার্ট ফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই টিকটক, লাইকি ভিডিও করা সম্ভব। এসব ভিডিও করতে খুব বেশি গতির ইন্টারনেটের প্রয়োজন হয় না। তাই শুধু শহর নয় গ্রামেও এর ব্যবহারকারী ছড়িয়ে আছে। অ্যাপটি ডাউনলোড করে একটি একাউন্ট তৈরি করে খুব সহজেই ভিডিও সম্পাদনা করা যায় এবং শেয়ার করা যায় মুহুর্তেই। যার কারনে রাতারাতি পরিচিত লাভের আশায় তরুন প্রজন্ম এসবে আগ্রহী হয়ে উঠছে। টিকটক, লাইকি ভিডিওতে মুনাফা লাভের বিষয়টিও লক্ষনীয়।
লাইকিতে লাইভের মাধ্যমে আয় করার সুবিধাও আছে। লাইকিতে প্রতি ৫০০ ভিউয়ের জন্য পাওয়া যায় একটি করে'ডায়মন্ড। প্রতি ডায়মন্ডের জন্য পাওয়া যায় ৪০ টাকা। যাদের ফলোয়ার বেশি এবং ভিউ বেশি তাদের আয় খারাপ না। অনেকেই মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করে ফেলছে শুধুমাত্র টিকটক আর লাইকি ভিডিও করেই। যার কারনে অসময়ে অর্থ প্রাপ্তির লোভে অনেক তরুন-তরুনী টিকটকের নেশায় বুদ হয়ে যাচ্ছে। মানসম্পন্ন কিংবা মানহীন, অর্থপূর্ণ কিংবা অর্থহীন নানা কিছু নিয়ে তৈরি হচ্ছে ভিডিও। ব্যাঙ্গাত্মক মুখভঙ্গি, নাটক বা সিনেমা রাজনৈতিক বক্তব্য, ওয়াজ মাহফিল, গানের সাথে ঠোঁট মেলানো প্রভৃতি নিয়ে ভিডিও নির্মান করা হয়।
কিন্তু বেগের বিষয় এই যে নিছক বিনোদনের জন্য তৈরি হলেও এসব আর বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মান কিংবা বক্তব্য কোনোটার উপরে প্রাধান্য না দিয়েই তৈরি হচ্ছে ভিডিও। সেসব ভিডিওতে প্রাধান্য পাচ্ছে যৌনতা, অশ্লীলতা। এছাড়া ট্রল, সহিংসতাসহ নানা রকম কুরুচিপূর্ণ কন্টেন্ট। মনোযোগ আকর্ষণ করার উদ্দেশ্য অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ভিডিও তৈরি করতেও পিছুপা হয় না এসব তরুন-তরুনীরা। মানহীন এসব কন্টেন্টের ফলোয়ার লাখ লাখ। কখনো কখনো কোটি ছাড়িয়ে যায়। পেজে ফলোয়ার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অনেক সময় দলবদ্ধ হয়ে টিকটক, লাইকি ভিডিও করতে দেখা যায়। তরুন ও কিশোররা গ্যাংয়ে জড়িয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। হয়ে উঠছে সহিংস।
টিকটকের শুটিং চলে রাজধানীর প্রায় সব বিনোদন কেন্দ্রে। বিনোদন কেন্দ্র গুলো যেনো টিকটকারদের আস্থানা। বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরতে আসা মানুষ গুলোকেও তটস্থ থাকতে হয় এসব কিশোরদের ভয়ে। আগারগাঁও, চন্দ্রিমা উদ্যান, হাতির ঝিল, দিয়াবাড়ি সহ দেশের বিভিন্ন জায়গা দখল করে চলে টিকটক আর লাইকির শুটিং। অনেক সময় রাস্তার ফুটপাত দখল করেও শুটিং চলে। শুটিংয়ে কেও বাধা দিলে এসব টিকটকাররা তাদের প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে। মারধর, আক্রমণ করে থাকে। দল ভারি করতে অন্যদেরকেও দলে ডেকে আনা হয়। শুটিংকে কেন্দ্র করে চলে অবৈধ পুল পার্টি। রাতভর চলতে থাকে অশ্লীলতা।
অনেক সময় এসব শুটিংয়ের মধ্যেই চলতে থাকে অশ্লীলতা। অনেকেই না বুঝে রাতারাতি তারকা বনে যাওয়ার উদ্দেশ্য যোগ দেয় এসব গ্যাংয়ে। তারকা বানিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয় অনেক তরুণীকে। গ্যাংয়ের কবলে পড়ে মাদকাসক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়ে অধিকাংশ। বিদেশি অপসংস্কৃতির অনুসরণ করে পোশাক পরিচ্ছেদ, চুলের রঙে ভিন্নতা এনে এসব ভিডিও তৈরি করছেন। বিব্রতকর এসব ভিডিওর ভিউয়ার লাখ লাখ। এবং এদের অনুসারীরাও এসব সংস্কৃতি অনুসরণ করতে থাকে। শুধু রাজধানী কিংবা শহরগুলোতেই সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামেও এর প্রভাব। সামাজিকভাবে যদি এই মহামারী গুলো রোধ করা না যায় তা হলে ধ্বংস হয়ে যাবে আগামী তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।
এমএসএম / জামান

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
