ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষকের ভূমিকা


শাহাব উদ্দীন মাহমুদ সালমী photo শাহাব উদ্দীন মাহমুদ সালমী
প্রকাশিত: ১২-১২-২০২৩ দুপুর ৩:২৩

শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো তার সুনিপুণ কারিগর। ফ্রেডরিক ফ্রয়েবল বলেন-“শিশু হলো উদ্যানের চারাগাছ। শিক্ষক হলেন তার মালী। শিক্ষকের কাজ হলো সযত্নে চারাগাছটিকে বড় করে তোলা। শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৎ ও সমাজিক গুনাবলীর বিকাশ সাধন করা শিক্ষকের কর্তব্য”। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও।

শিক্ষকের ইতিবাচক ভূমিকার কারণে শিক্ষার্থীর মন-মনন, মানসিক উৎকর্ষ সাধন, আচার-আচরণ, আত্মার ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন, মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির সুদুর প্রসারি পরিবর্তণের প্রভাব ফেলে। শিক্ষার্থীদের যোগ্য, আদর্শ, দেশপ্রেমিক, মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শ্রেণি কার্যক্রমের প্রভাব অনেক বেশী। শ্রেণি ব্যবস্থাপনার মুল কাজটি পরিচালিত হয় শিক্ষকের সরাসারি তত্বাবধানে। তাই শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষকের আন্তরিকতা এবং কলা কৌশলের উপর নির্ভর করে শ্রেণি ব্যবস্থাপনার সফলতা। শ্রেণি ব্যবস্থাপনার সফলতার উপর শিক্ষার্থীর শিখন আগ্রহ বৃদ্ধি পায় যা মান সম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। শ্রেণি ব্যবস্থপনার সাথে শুধুমাত্র পড়ালেখার সম্পর্ক আছে তা নয়। এরসাথে শিক্ষার্থীর চরিত্র, মানবিকতা, চাল চলন, আচরণ সহ জীবন যাপনের অনেক কিছুই জড়িত। এক্ষেত্রে শিক্ষককের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৃষ্টির আদি থেকেই শিক্ষার্থীর শিখন কার্যক্রমের সাথে শিক্ষকের ভূমিকার কথা জানা যায়। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পাঠদান কলা কৌশলে উন্নতি হলেও আদর্শ শ্রেণি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শিক্ষকের নিজস্ব মেথডই সেরা বলে অধিকাংশই মত দেন। কেননা শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, শিক্ষার্থীর আগ্রহ, রুচি, মেধা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।

শ্রেণি ব্যবস্থাপনা:

শিক্ষক শিক্ষাক্রমের আলোকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়াকে সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকেন সেটাই শ্রেণি ব্যবস্থাপনা। শ্রেণি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষক কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। 

শ্রেণি ব্যবস্থাপনার কৌশল:

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাঠদান ও পাঠগ্রহণের অন্যতম প্রধান উপদান হলো শ্রেণিকক্ষ। শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষককে কিছু নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। শিক্ষার্থীদের কাছে সহজভাবে প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের জন্য শ্রেণিকক্ষের বিকল্প নেই। তাই শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং উক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিহার্য।

কার্যকরী শ্রেণি ব্যবস্থাপনার জন্য আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (American Psychological Association-APA) শিক্ষকদের জন্য ৮টি পরামশের কথা বলেছেন। পরামর্শগুলো হলো:
১.    শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অষ্পষ্ট নিয়ম ব্যবহার করা যাবে না।
২.    পাঠদানের জন্য যে সকল নিয়ম ব্যবহাওে শিক্ষক ইচ্ছুক নন, সেসব নিয়ম ব্যবহার করা যাবে না (অনিচছা স্বত্বেও)
৩.    শিক্ষার্থীদের যে সকল আচরণ শ্রেণিকক্ষে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে সে সকল আচরণ এড়িয়ে না যাওয়া।
৪.    শ্রেণিকক্ষে অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করা যাবে না।
৫.    শিক্ষার্থীদের সাথে অতিরিক্ত কঠোর হওয়া যাবে না বা শিক্ষার্থীদেরকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে এমন কোনো শাস্তি প্রদান করা যাবে না।
৬.    শারীরিক শাস্তি প্রদান করা যাবে না।
৭.    ‘আউট-অব-স্কুল-সাসপেনশন’ যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে।
৮.    শিক্ষার্থীদের মারাত্মক কোনো সমস্যা শিক্ষকের একা সমাধান করা যাবে না, এক্ষেত্রে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক অথাব পেশাদার মনোবিশারদ বা পেশাদার শিক্ষা পরামর্শকের পরামর্শ নিতে হবে।
শ্রেণি ব্যবস্থপনার বিভিন্ন ধাপ বা কৌশল সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে বলেছেন। তবে প্রত্যেক শিক্ষক শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব কিছু কৌশল প্রয়োগ করে থাকেন। শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষকের কৌশল প্রয়োগের দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিবর্তন এবং উন্নত হয়। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আলোকে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেই আলোকে শ্রেণি ব্যবস্থাপনার অনুসঙ্গ হিসেবে যে সব উপাদান বা বিষয় মাথায় রাখতে হবে বলে মনে হয়েছে তা তুলে ধরছি। বিষয়গুলো শিক্ষক নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারবেন।
১.    শুভেচ্ছা বিনিময় ও হাসি খুশি ভাব।
২.    শিক্ষকের পর্যাপ্ত বিষয় জ্ঞান।
৩.    শিখন ফল অনুযায়ী পাঠ পরিকল্পনা/পূর্ব প্রস্তুতি প্রণয়ণ।
৪.    পাঠ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবহার।
৫.    সময়মতো শ্রেণি কক্ষে প্রবেশ এবং সুষ্ঠু ব্যবহার।
৬.    ওয়ার্ম আপের মাধ্যমে পাঠ উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি।
৭.    শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় শ্রেণি সজ্জিতকরণ।
৮.    শ্রেণি বিন্যাস/আসন বিন্যাস- বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, পিছিয়ে পড়া, অনিয়মিত, স্বল্প মেধা সম্পন্ন, অতি মেধাবী, সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থী।
৯.    শিক্ষার্থীর শিখন চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ সমূহ বিবেচনায় নিয়ে আসন বিন্যাস।
১০.    সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের একক, জোড়ায় এবং দলগত উপস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি।
১১.    একক, জোড়ায় ও দলগত কাজ প্রদানের পূর্বে সঠিক নির্দেশনা এবং উপকরণ সরবরাহ।
১২.    ধীরগতি ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সময় বেশী দেওয়া।
১৩.    শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া।
১৪.    শিখনের জন্য মূল্যায়নের উপর গুরত্বারোপ।
১৫.    মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন ফল অর্জন যাচাই।
১৬.    শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন বা যাছাইয়ের জন্য প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বয়স, চাহিদা ও সামর্থ বিবেচনায় নেওয়া।
১৭.    পদ্ধতি অনুসরণ বা পরিকল্পিত কাজ।
১৮.    অপ্রাসঙ্গিকতা পরিহার করা।
১৯.    শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান এবং পুরস্কার প্রদান।
২০.    প্রমিত উচ্চারণে ষ্পষ্ঠ ভাষায় সাবলীল উপস্থাপন।
২১.    নির্ভূল তথ্য প্রদান ও স্পষ্ট নির্দেশনা।
২২.    শিক্ষার্থীর মনোযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করা।
২৩.    শ্রেণি উপযোগী কন্ঠস্বর।
২৪.    শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক।
২৫.    শিক্ষকের অবস্থান এবং দৃষ্টি বিনিময় সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান থাকা।
২৬.    অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ।
২৭.    বোর্ড বা খাতায় লেখার সময় শুদ্ধ বানান এবং স্পষ্ঠভাবে লেখার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
২৮.    শিক্ষকের ব্যক্তিত্বে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, শালীন ও রুচিশীল পোশাক।
২৯.    শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান নজর রাখা এবং শিক্ষার্থীর নাম ধরে ডাকা।
৩০.    শিক্ষার্থীদের বিদায়ী শুভেচ্ছা জানানো।
বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হলে শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় নুতন নুতন ধারণার সন্নিবেশ করতে হবে। শ্রেণি ব্যবস্থাপনার প্রধান কারিগর শিক্ষক। শ্রেণি ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন তথা শিক্রাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকতায় মেধাবী যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমাতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকগণ যেন পাঠদানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার সহিত মনোনিবেশ করতে পারে সেজন্য অন্যান্য দেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষানীতির প্রস্তাবনা অনুযায়ী ক্যারিয়ার পাথ তৈরি করে পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধি এবং বেতন কাঠামোর উন্নয়ন করা হলে শ্রেণী ব্যবস্থাপনা আরো সুশৃঙ্খল হবে। যা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক হিবেবে কাজ করবে।

শাহাব উদ্দীন মাহমুদ সালমী
শিক্ষক ও লেখক।

এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া