সময়ের অপেক্ষায় আ.লীগ!
টানা তিন মেয়াদের ক্ষমতা শেষ করে চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা ভাঙাগড়ার মধ্যদিয়ে গেছে দলটি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বর্তমানের মতো এতটা বিপর্যায়ের মুখে পড়তে হয়নি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করেন দলটির সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এক মাসের বেশি সময় অতিক্রম করলেও এখন পর্যন্ত দলের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো বলতে কিছু ছিল বা আছে তা বোঝা যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধুমাত্র রাজনীতিকে বাণিজ্যিকীকরণের কারণে দলটির এই অবস্থা। তারা মনে করছেন, ত্যাগী ও মাঠের নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে ব্যবসায়ীদের দলে ভেড়ানোর জন্য প্রকৃত রাজনীতিবিদরা দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এতে পুরনো রাজনৈতিক দলটি ছাত্র আন্দোলনের মুখে এভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কেন দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে সব নেতাকর্মীকে আত্মগোপনে যেতে হলো, সেটিও ভাবনার বিষয় বলে মনে করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা দীর্ঘ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবিধা নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার কথা থাকলেও তা না করে ব্যক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন দলটির শীর্ষ নেতারা। ক্ষমতা হাতেগোনা কয়েকজনের কাছে কুক্ষিগত থাকায় মূল্যায়ন করা হয়নি দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের। এ কারণে দুঃসময়ে কাউকে পাশে পাচ্ছে না দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলটি। মুষ্টিমেয় নেতার কারণে অবহেলিত ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতা। হঠাৎ ক্ষমতাচ্যুতির জন্য দুর্নীতিবাজ আর দুর্বৃত্তপরায়ণ নেতাদের দুষছেন আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, নানা কৌশলে দীর্ঘদিন টানা ক্ষমতায় থেকে যেতে পারায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। মূল্যায়ন করা ছাড়াই যেহেতু সব ঠিকঠাক চলছিল, তাই এদিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বরং ব্যবসায়ীদের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে ৬০ শতাংশের বেশি সংসদ সদস্যের চেয়ার ছিল ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ। যেখানেই টাকাওয়ালা পাওয়া গেছে, তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়েও মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। বাদ পড়েছেন দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতারা। আবার এমপি কিংবা মন্ত্রীর আত্মীয়রাও বাগিয়ে নিতেন উপজেলা বা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের মনোনয়ন। সব জায়গায় আত্মীয়করণের প্রবণতা ছিল প্রবল।
এসব বিষয় সকালের সময় প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার। এতে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিভিন্ন সম্পাদক ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রয়েছেন। তারা জানান, ‘ওরা দেশটা গিলে খাইছে, ওরা আওয়ামী লীগকেও গিলে খাইছে। আমাদের কথা শুনে নাই। আমার সঙ্গে কারো যোগাযোগ নেই। এখন রাজনীতিতে নেই। দেখি তারা কী করে। যারা আছে তারা দল চালাক।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের অনেকগুলো উইং দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তারা কোনো কাজ করতে পারত না। উপর মহলের নির্দেশ বাস্তবায়নে দিন পার করত। সেসব উইংয়ের যে নিজস্ব কিছু কাজ আছে, সেগুলো ভুলে গিয়েছিল। সরকার পতনের এক মাস পেরিয়ে গেল। অথচ এই সময়ের মধ্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও দেয়া গেল না! এতেই প্রমাণিত হয় উইংগুলো কাজের যোগ্যতা হারিয়েছে। এখন দলটাকে পুনর্গঠন করতে হবে। ব্যক্তিবিশেষে দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে না। রাজনীতিতে অভিজ্ঞদের অবহেলা না করে কাজে লাগাতে হবে। আওয়ামী লীগকে সক্রিয় করতে হলে তৃণমূলকে সক্রিয় করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন তো দলকে পুনর্গঠন করার মতো সময় নয়। কিন্তু তারপরও দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। যাদের কারণে আজ এমন পরিণতি তাদের চিহ্নিত করতে হবে। আপাতত নেতাকর্মীরা নিরাপদে থাকুক। সময় ও পরিস্থিতি বুঝে দলকে গোছাতে হবে।
নেতারা জানান, আওয়ামী লীগের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল। সেটি নামমাত্র ছিল। কমিটিকে এক সাইডে রেখে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল কয়েকজনের হাতে। তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছিলেন ক্ষমতা চর্চার কেন্দ্রে। তারাই আওয়ামী লীগকে পরিচালনা করেছে। অনেক বিষয়ে তারা জানতেন কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানতেন না। এরা দলের হাইকমান্ডকে দেশের সঠিক পরিস্থিতি বা সঠিক তথ্য দিতেন না। সে কারণে আজ আওয়ামী লীগের এমন করুণ পরিণতি।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ছিল ৮১ সদস্যবিশিষ্ট। কিন্তু এখানে কয়জন সক্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন? এমনও আছেন, যাদের দেশের মানুষ চেনেই না। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের মতো দলে কেন অপরিচিত বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে ভেড়াতে হবে? তারা কি দলের দুর্দিনে থাকবেন? এখন দেখেন তারা কিন্তু নেই। আমরা দলে থাকলেও দলের মধুটা কিন্তু উনারাই খেয়েছেন। সরকার পরিচালনা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই তারা সামনের সারির লোক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা বাড়াবাড়ি করেছেন।
এছাড়া ‘আওয়ামী লীগের একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। সেখানে অনেক অভিজ্ঞ নেতা ছিলেন। করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত নেত্রী তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন। পরবর্তীতে হাইব্রিডরা নেত্রীর আশপাশে ভিড়তে থাকে। তাকে সিনিয়রদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলে। নেত্রীর আশপাশে সিনিয়ররা থাকলে এমন আন্দোলন মোকাবিলা করা কোনো বিষয় ছিল না। সঠিক তথ্যটাই নেত্রী পাননি।
এমএসএম / এমএসএম