রেলের টিকেট বিক্রিতে ফিরেছে স্বচ্ছতা, বেড়েছে আয়
নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে এবার নিজেদের অনেকটাই শুধরে নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকতারা। অবৈধ যাত্রী পরিবহন ঠেকাতে ব্লকিং সিস্টেম বন্ধ করে সব টিকেট উন্মুক্ত করা হয়েছে। টিকেট বিক্রিতে স্বচ্ছতা ফিরে এসেছে। বাণিজ্যিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ট্রেনে টিকেট চেকিং জোরদার করা হয়েছে। ফলে বেড়েছে রেলের আয়। তবে নিরাপদ ও আরামদায়ক যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক কর্মকর্তাদের পূর্বের মতো রেল অঙ্গণে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (সিসিএম) মো. মাহবুবুর রহমান।
জানা যায়, টিকেট কালোবাজারি ও বিনা টিকেটে যাত্রী পরিবহনে আগে ১৬ বছরে ৮ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে রেলওয়ে। এই নিয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক সকালের সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ফলে এসব খাতে স্বচ্ছতা ফেরাতে নেয়া হয় নানা কৌশল। এরই অংশ হিসেবে অফিসারদের ট্রেন পরিদর্শন বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিনা টিকেটের যাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ে আরো সক্রিয় হয়েছে টিটিসহ সংশ্লিষ্টরা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলেল বাণিজ্যিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের যাত্রী পরিবহনে টার্গেট ছিল ৭১ কোটি ৩২ লাখ টাকা আর আয় করেছে ৭৫ কোটি ৮৬ লাখ, এর আগের মাসে যার পরিমান ছিল ৩৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। আবার গত বছর সেপ্টেম্বরে যাত্রী পরিবহন থেকে আয় এসেছে ৬৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। একই সময়ে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে যাত্রী পরিবহন থেকে ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা বেশি আয় করেছে। তবে অন্যান্য আয় তেমন বাড়েনি। পার্সেল থেকে সেপ্টেম্বরে এসেছে ৬৮ লাখ, গুডস ৯ কোটি ৫৭ লাখ, টিএফসি কম ২ কোটি ৯ লাখ টাকা। টোটাল টিএফসির টার্গেট ছিল ৯৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা কিন্তু আয় হয়েছে ৮৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। গতবছরের একই সমেয় আয় করেছে ৭৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর ২০২৩ এর তুলনায় ২০২৪ এর একই মাসে ১০ কোটি ২৮ লাখ টাকা বেশি আয় করেছে। আবার ২০২৪ সালের জুলাই মাসে টিটিগণ যাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানাসহ আয় করেছে ৮৪ লাখ ৭৮ হাজার ৮৭৯ টাকা। আগস্টে ৬১ লাখ ১ হাজার ৩৬৭ টাকা আর সেপ্টেমরে এই আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৩৪ লাখ ১৯ হাজার ৮৩ টাকা।
রেলওয়ে সুত্র জানায়, ২০০৮ সালে রেলের মোট আয়ের প্রায় ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ আয় এসেছে আন্তঃনগর ট্রেন থেকে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ২ টি অঞ্চলে (পূর্ব ও পশ্চিম) বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেন আছে ১১০টি বা ৫৫ জোড়া। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৫৪ ও পশ্চিমাঞ্চলে ৫৬ টি।
রেল ভবন সুত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। একই সময়ে আয় করেছে ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করেছে রেলওয়ে।
এব্যপারে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (সিসিএম) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ’আমরা বরাবরই স্বচ্ছতা বজায় রেখে নিরাপদ ও আরামদায়ক যাত্রী সেবা দিতে প্রস্তুত। একই সাথে আয়টাও যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। তবে লোকবল সংকটসহ নানাবিধ সমস্যা আমাদের পিছু ছাড়ছেনা। ফলে বিনা টিকেটে রেল ভ্রমন ঠেকানো শুন্যের কোটায় আনা সম্ভব হচ্ছেনা। আগে প্রতিটি ট্রেনে ৫ জন টিটির একটি টিম থাকত এখন লোক সংকটের ফলে সেখানে ২/৩ জনের বেশি দেয়া যাচ্ছেনা। ফলে অল্প সংখ্যক টিটি এতো এতো লোকের টিকেট চেক করে অবৈধ যাত্রী চিহ্নিত করা অনেকটা মুশকিল। অন্যদিকে আগের তুলনায় অবৈধ যাত্রীরা একটু বেশি বেপরোয়া। তারা টিটিসহ রেলের কর্মকর্তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়না। আইন প্রয়োগ করতে গেলে অশোভন আচরণের মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়, দেয়া শাস্তিও। ফলে দায়িত্বরতরাও রিস্ক নিতে চায় না।’
এই সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ’ ২০০৭ সালের আগে রেল অঙ্গণে ১১৩ ও ১১৪ ধারায় বাণিজ্যিক বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ছিল, টিকেটবিহীন কোন যাত্রী ট্রেনে ওঠার কথা চিন্তাও করেনি জেল জরিমানা বা মান সম্মানের ভয়ে। ফলে তখন যাত্রীরা নিরাপদে ও আরামে ভ্রমণ করতে পারতো। কিন্তু ২০০৭ সালে রহস্যজনক কারনে সেই পাওয়ার খর্ব করা হয়েছে। এখন আমাদের সেই পাওয়ার না থাকায় যাত্রীরা কাউকে মানেনা। ফলে অহরহ যাত্রীরা টিকেট ছাড়াই ট্রেনে ওঠে পড়ে। আমরাও আগের মতো ব্যবস্থা নিতে পারিনা। তবু আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করছি যাত্রী সেবার মান রক্ষা করে আয় বৃদ্ধি করার।’ টিটি সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ’টিটি সরাসরি নিয়োগ হয়না, এই পদটি টিসি থেকে প্রমোশনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ফলে টিটির সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে আমাদের আরো ৩/৪ বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো ও নিরাপদ সেবা নিশ্চিত করতে রেল অঙ্গণে কর্মকর্তাদের আগের মতো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার পূণর্বহাল করা একান্ত প্রয়োজন।
সুত্র জানায়, ১৯৮৫ সালে দেশে আন্তঃনগর রেল সেবা চালু হওয়ার পর ২০০৮ সালে মোট যাত্রীর প্রায় ৩৮.৫% আন্তঃনগর ট্রেনের মাধ্যমে যাত্রা করে। ২০১৬ সালে দেশে মোট ৩৪৭টি যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালিত হয়, যার মধ্যে আন্তঃনগর ৯০টি; মেইল, এক্সপ্রেস ও ডেমু ১২০টি এবং লোকাল ১৩৫টি। ২০২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে মোট ১০৪টি আন্তঃনগর (আপ ও ডাউন), ৫২টি মেইল/এক্সপ্রেস, ৬৪টি কমিউটার (ডেমু) ও ১৩৫টি শাটল/লোকাল ট্রেন পরিচালনা করে। এসব ট্রেনে ২০০৩/৪ অর্থবছরে প্রায় ৪ কোটি ৩০ লক্ষ যাত্রী ভ্রমণ করেন। আবার ২০১৩/১৪ অর্থবছরে রেলপথে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি যাত্রী ভ্রমণ করে।
এমএসএম / এমএসএম