বর্তমান বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট ও মোকাবেলা

গত ১৬ বছরের কার্যফলে বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বেশ কিছু সমস্যার কারণে সংকট তৈরি হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার চিত্র দেখা যাচ্ছে। এই ব্যর্থতার পেছনের মূল কারণগুলোর হলো:
১. খেলাপি ঋণ (NPL) বৃদ্ধি: ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান এবং পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি, রাজনৈতিক চাপের কারণে অপর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই এবং কিছু ঋণগ্রহী তার ইচ্ছাকৃত ঋণ পরিশোধ না করা। যার ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বৃদ্ধি পায়, যা তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকলে ব্যাংকের পুঁজির অবস্থা দুর্বল হয় এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়।
২. দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব:
ব্যাংকিং খাতে উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি, যেখানে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সহজে বড় অঙ্কের ঋণ পেয়েছে যা পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে গেছে। যার ফলে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা থাকে না, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতে অনাস্থা এবং অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়।
৩. নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের অভাব:
বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমে দুর্বলতা। ব্যাংকগুলোর উপর পর্যাপ্ত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের অভাব, যার ফলে অনেক সময় নিয়ম ভঙ্গ করা হয় এবং ব্যাংকগুলো অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। যার ফলে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে যায় এবং সঠিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে অনেক সমস্যা সামনে আসে যা মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৪. পুঁজির অভাব এবং তারল্য সংকট: পুঁজির অভাব, বিশেষ করে যারা খেলাপি ঋণে ভুগছে। এছাড়া তারল্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনা ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে। যার ফলে ব্যাংকগুলো যথাযথ ঋণ প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহ করতে পারছে না এবং সঠিকভাবে বাজারের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৫. কর্পোরেট গবর্ন্যান্সের দুর্বলতা: ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, যেখানে বোর্ডের সদস্যরা প্রায়ই ব্যাংকিং কার্যক্রমে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নয় বরং রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে নির্বাচিত হন। যার ফলে দুর্বল কর্পোরেট গবর্ন্যান্সের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো ভুলভাবে নেওয়া হয়, যা ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমকে ব্যাহত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের স্থায়িত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৬. অর্থনৈতিক চাপ এবং মুদ্রানীতি: দেশের অর্থনৈতিক চাপ, যেমন মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তন। এছাড়া মুদ্রানীতির অকার্যকারিতাও এর জন্য দায়ী। যার ফলে এই ধরনের অর্থনৈতিক চাপ ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট এবং অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করে, যা ব্যাংকগুলোর সক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়।
৭. নিরাপত্তার অভাব ও সাইবার ঝুঁকি: ব্যাংকগুলোর তথ্য প্রযুক্তি এবং সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দুর্বলতা, যা সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
যার ফলে সাইবার আক্রমণের কারণে ব্যাংকিং কার্যক্রমে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে এবং গ্রাহকদের আস্থা কমে যায়।
৮. বিশ্বাস এবং স্বচ্ছতার অভাব: ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং নিয়মিত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে গ্রাহকদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা কমে যাচ্ছে। যার ফলে গ্রাহকরা ব্যাংকে অর্থ রাখার ব্যাপারে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ছে এবং ফলে তারল্য সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
৯. উচ্চ প্রশাসনিক খরচ: অনেক ব্যাংকেই উচ্চ প্রশাসনিক খরচ রয়েছে যা তাদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং তাদের পরিচালনা করতে সমস্যা হয়। যার ফলে ব্যাংকগুলোর জন্য পরিচালন ব্যয় বেড়ে যায়, যা তাদের মোট আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তারল্য সংকট বাড়িয়ে দেয়। এই সবগুলো কারণ মিলিতভাবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকিং খাতের সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে সুশাসন, নিয়ন্ত্রণ, এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে।
সংকট মোকাবেলা:
বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মানসম্মত করার এবং তারল্য সংকট কমানোর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
ক. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম ও নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা: অগ্রাধিকারমূলক সুদের হার নির্ধারণ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক)কে মুদ্রানীতি শক্তিশালী করে সুদের হার এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তারল্য থাকে এবং তারা সহজে ঋণ প্রদান করতে পারে। তারল্য সরবরাহ বৃদ্ধি: ব্যাংকগুলোর মধ্যে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ দেওয়া বা লং টার্ম রেপো (খঞজঙ) সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি: ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং কোনও ধরনের অনিয়ম বা ঝুঁকি দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
খ. অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সংস্কার: খারাপ ঋণ (ঘচখ) হ্রাস: ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের (ঘচখ) পরিমাণ কমাতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট কমবে এবং তাদের নতুন ঋণ প্রদানের সক্ষমতা বাড়বে। কর্পোরেট গবর্ন্যান্স: ব্যাংকগুলোর কর্পোরেট গবর্ন্যান্স উন্নত করতে হবে যাতে কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। এর ফলে তারল্য ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে। আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশন: ব্যাংকিং কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করতে হবে, যাতে লেনদেন প্রক্রিয়া দ্রুত ও নির্ভুল হয় এবং অপারেশনাল খরচ কমে যায়।
গ. আস্থা পুনরুদ্ধার এবং বিনিয়োগ উৎসাহিত করা: বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা: ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক মানের স্বচ্ছতা ও শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়তে পারে। সঞ্চয় এবং ঋণ প্রণোদনা: সঞ্চয় উৎসাহিত করতে উচ্চ সুদের হারের স্কিম চালু করা যেতে পারে এবং ঋণ গ্রহণকে সহজ করতে ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ প্রণোদনা চালু করা যেতে পারে। মাইক্রোক্রেডিট সম্প্রসারণ: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেলকে আরও সম্প্রসারিত করে গ্রামীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমকে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
ঘ. সম্পদের বৈচিত্র্যকরণ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: বৈচিত্র্যকরণ: ব্যাংকগুলোর সম্পদ বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে, যাতে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো যায়। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা: ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি শক্তিশালী করতে হবে, যাতে তারা অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি এবং তারল্য সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।
ঙ. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ: বেসেল ওওও (ইধংবষ ওওও) বাস্তবায়ন: ব্যাংকগুলোর পুঁজির পর্যাপ্ততা, তারল্য, এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত করার জন্য বেসেল ওওও মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। অগখ/ঈঋঞ সম্মতি: মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে নিয়মিতভাবে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে।
চ. স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ব্যবস্থাপনা: স্বল্পমেয়াদী তারল্য ব্যবস্থাপনা: বাজারের চাহিদা মেটাতে স্বল্পমেয়াদী ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আর্থিক বাজারে তারল্য সংকট কমানো যায়। দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সংস্থান: দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদী বন্ড ইস্যু এবং অন্যান্য বিকল্প আর্থিক পণ্য প্রচলন করতে হবে।
ছ. বাজারের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা: নগদ অর্থের প্রাপ্যতা: বাজারে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে লেনদেন প্রক্রিয়ায় কোনও রকম বাধা না আসে। বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি: ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়াতে নতুন আর্থিক পণ্য ও সেবা চালু করতে হবে, যা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মানসম্মত হবে এবং তারল্য সংকট কমে আসবে। ফলে ব্যাংকগুলো আরো কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে এবং অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: কলামিস্ট
এমএসএম / এমএসএম

মার্কেটিং বিক্রি বাড়ায়, যোগাযোগ ব্র্যান্ড তৈরি করে

নির্বাচনী ব্যবস্থায় গণমাধ্যম নীতিমালার প্রস্তাবিত সংস্কার ও গণমানুষের প্রত্যাশা

বাংলাদেশ সংবিধানের আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ প্রেক্ষিতঃ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত

শতাব্দির সেরা মাটির সৈনিক কৃষক যোদ্ধা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ও জনগণের প্রত্যাশা

ট্রাম্প-সালমান কথোপকথনে বিশ্ব কী বার্তা পেল

এফবিসিসিআইর ডিজিটাল রূপান্তর : ব্যবসায়িক নেতাদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সেবা

জাতীয় ঐকমত্য কঠিন হলেও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অনন্য উচ্চতায় তারেক জিয়া

কেমিক্যাল আতঙ্ক নয়, চাই বিজ্ঞানসম্মত আমচাষ ও প্রশাসনিক সচেতনতা

শুভ অক্ষয় তৃতীয়া: দানে ধ্যানে অনন্তকালের পূণ্যলাভ

শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার ও গুরুত্ব, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
