সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃত ৪শ’ কোটি টাকার পিয়নের দাপট
এনসিটিবি’র পাঁচ কর্মকর্তার অবৈধ পদোন্নতি, এখনো বহাল তবিয়তে
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অবৈধভাবে পদোন্নতি দেয়া পাঁচ কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তাদের পদোন্নতিতে অনিয়মের অভিযোগ বোর্ডেরই কর্মকর্তারা করেছিলেন। কিন্তু সুনিদিষ্ট সেই অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হনি। এর কারণ হিসেবে বহুল আলোচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃত ৪শ’ কোটি টাকার পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম প্রভাব খানিয়েছেন বলে এনসিটিবি ভবনে আলোচনা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এনসিটিবি’র কর্মকর্তাদের উত্থাপিত অভিযোগটি কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়ে তা তদন্ত করতে চার সদস্যের একটি তদন্ত গঠন করা হয়। বোর্ডের তৎকালীণ উপসচিব (প্রশাসন) শাহ ফিরোজ আল ফেরদৌসকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের কমিটিকে গত ২০২০ সালের ১০ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
তদন্ত কমিটি এনসিটিবি’র তৎকালনীর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. রেজাউল ইসলাম, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, কস্টিং অফিসার মো. আব্দুর রশিদ, উপ-উৎপাদন নিয়ন্ত্রক মাহমুদা খানম, উপ-বিতরণ নিয়ন্ত্রক বি এম জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অবৈধ পদোন্নতি নেওয়ার অভিযোগটি প্রমাণ পান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. রেজাউল ইসলাম বোর্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন প্রকল্পের সহকারী সম্পাদক (ইংরেজি) পদে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৯৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি যোগদান করেন। আর বোর্ডের চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী সহকারী সম্পাদক থেকে অন্য কোন পদে পদোন্নতির সুযোগ না থাকায় রেজাউল ইসলাম গত ২০০১-২০০৬ এনসিটিবি কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সহকারী সম্পাদক হতে এস্টেট অফিসার হিসেবে বদলিভিত্তিক পদায়ন নেন। পরবর্তীতে তিনি বদলি হওয়া পদ’কে মূল পদ হিসেবে বোর্ডের চাকুরী প্রবিধানমালা, ১৯৯১ অমান্য করে সহকারী সম্পাদক (ইংরেজি) থেকে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি নেন। আবার রেজাউল ইসলামের মতো একই ভাবে আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, মাহমুদা খানম, আব্দুর রশিদ সহকারী সম্পাদক হিসেবে প্রকল্পে অস্থায়ী নিয়োগ পান।
সুত্র জানায়, তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর মোস্তাফিজুর এই অনৈতিক ভাবে পদন্নোতির নায়ক। তারা যেভাবে পদন্নোতিক পেয়ে যোগদান করেছেন। সেই পদে পদন্নোতির কোন প্রকার সুযোগ নেই। তাই পরে সেখান থেকে এই মানের অন্য পদে তাদেরকে বদলী করা হয়। এরপর সেই পদ থেকে তাদেরকে পদন্নোতি দেয়া হয়েছে। এনসিটিবির প্রবিধানে কোন সুযোগ নেই। এ ঘটনায় ২টি কমিটিও করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিএম জসিম উদ্দিন পুনরায় পদন্নোতির জন্য আবেদনও করেছেন। আর তারা সেই তদন্ত কমিটির মুখোমুখিও হয়েছিলেন। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্ট এখনো আলার মুখ দেখেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিরাট অংকের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তৎকালীন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে উল্লেখিত পাঁচ কর্মকর্তা অবৈধ পদোন্নতি বাগিয়েছেন। তাছাড়া বিএম জসিম উদ্দিনও এদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কম্পিউটার অপারেটর ব্লক পদ থেকে অবৈধ পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। আর একই বছর অভিযুক্ত পাঁচজনের মধ্যে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. রেজাউল ইসলাম ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীকে বোর্ডের টাকা তছরুপ ও অদক্ষতার জন্য বিভাগীয় মামলায় তিরস্কার দণ্ড দেয়া হয়েছিল।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের মো. রেজউল ইসলাম, মো. ওয়াহেদ চৌধুরী, মো. আব্দুর রশিদ, মাহমুদা খানম ও বিএম জসিম উদ্দিনসহ পাঁচজন কর্মকর্তার অবৈধভাবে পদোন্নতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)ও তদন্ত করে। তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এর পত্র নম্বর ০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.----২১০.২২-২৩৫৬ স্বারক। তারিখ : ২৩.০৬.২০২২ইং। দুদক তদন্তপূর্বক শিক্ষামন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলে।এরপর শিক্ষামন্ত্রণায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এনসিটিবি’র তৎকালীন চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু বহুল আলোচিত এই দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত ফাইল চাপা পড়ে রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্যে সুত্র জানিয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে এনসিটিবি’র হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা রেজউল ইসলামের সেল ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি সকালের সময়কে বলেন, অফিসের যার কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন, তার কাছ থেকেই জানেন। আর অফিসিয়াল কথা অফিস টাইম বললে ভাল হয় বলে তার ফোন নম্বরটি কেটে দেন।
এনসিটিবি’র সহযোগি অধ্যাপক উপ-বিপরণ নিয়ন্ত্রক মাহমুদা খানম এর বিরুদ্ধেও ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক, মুদ্রণ, বাঁদাই ও পরিবহনের জন্য এজেন্ট নিয়োগ ও ঠিকদার নিয়োগে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শেখ ট্রেডার্স নাম একটি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ১২লাখ ও ৫ লাখ টাকার টেন্ডারের দরপত্রে অংশ গ্রহণ করলেও তাকে দেওয়া হয়নি। পরে তৃতীয়বার শেখ ট্রেডার্স নাম ওই প্রতিষ্ঠান ৫২ লাখ টাকার দরপত্রের ট্রেন্ডারে অংশ গ্রহণ করলে তাকে দেওয়া হয়। এই অনিয়য়েমর সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুর ইসলাম, সচিব নাজমা আক্তার, সহযোগিত অধ্যাপক বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. রফিকুল ইসলাম, সহযোগি অধ্যাপক, উপ বিতরণ নিয়ন্ত্রক মাহমুদা খানম যোগসাজসে এই ঠিকদারের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এনসিটিবির সহকারী অডিট এন্ড বাজেট অফিসার শামীমা ইয়াসমিন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর অডিট ভবনে মহাপরিচালকের কাছে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।
এ ব্যাপারে উপ বিতরণ নিয়ন্ত্রক মাহমুদা খানম এর সেল ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি সকালের সময়কে জানান, আমি এনসিটিবি’র এতো কাছে থাকলেও এসব কিছুর কিছুই আমি জানি না। আর আমি কোন দুর্নীতি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই।
অপরদিকে এনসিটিবির চুক্তিভিত্তিক প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলামের অনিয়ম দুর্নীীতর তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। উক্ত অভিযোগে বলা হয়েছে, নতুন করিকুলাম তৈরীতে একইদিনে একাধিক কর্মশালায় সম্মানী গ্রহণ করা হয়েছে। আবার ৩ থেকে ৪টি শাখায় অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন কমিটি দেখিয়ে আপ্যায়নের জন্য ভাতা গ্রহণ করা হয়েছে। অনিয়ম করে এনসিটিবির বিভিন্ন পুরাতন মালামাল রাতের অন্ধকারে বিক্রয় করে অর্থ সরকারের বোর্ডের ফান্ডে জমা না দিয়ে প্রশাসনের সচিব, উপসচিবসহ ভাগ ভাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। আবার চলতি বছরের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য অর্থের বিনিময়ে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বোর্ডের ৫ জন কর্মকর্তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দূর্নীতি দমন কমিশনের নির্দেশের প্রেক্ষিতে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এছাড়া, এনসিটিবির কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের যোগাসাজসে প্রার্থমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বই মুদ্রণে কাগজের জিএসএম, ব্রাইটনেস ও অন্যান্য অনিয়ম ও দূর্নীতির মাধ্যমে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই মুদ্রণ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ উঠেছে। যা দদুকে তদন্ত চলমান রয়েছে। আর এই দূর্নীতিতে এনসিটিবির সচিব নাজমা আখতার, উপসচিব (কমন) সৈয়দ মোস্তাফিজুর রমান, উপসচিব (প্রশাসন) মো. ফিরোজ আল ফেরদৌস, (সদস্য শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান, (উৎপাদক নিয়ন্ত্রক) মো. সাইদুর রহমান, সিবিএন সভাপতি মো. সাজেদুল ওয়অহেদ খান ও সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মো. মোমিনুল ইসলাম।
সূত্র জানায়, নিয়ম অমান্য করে সিবিএ সভাপতি সাজেদুর ওয়াহেদ খান ও সাধারণ সম্পাদক মো. মোমিনুল ইসলাম দীর্ঘ প্রায় ১৫ দিন রাতের বেলায় পুরাতন মালামাল ঠিকাদারকে ডেলিভারি দিয়েছেন। যা সিসিটিভির ফুটেজে রয়েছে। উক্ত মালামালের দর ৬৫ লাখ ৪০ হজার ৩৭০ টাকা হলে ও বোর্ডের ফান্ডে মাত্র ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা জমা করা হয়েছে। আর ৫২ লাখ টাকার হদিস নেই বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ঢাকা অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন মোসা. রেবেকা সুলতানা। অথচ এই রেবেকার বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছিল মাউশির সাবেক ডিজি অধ্যাপক গোলাম ফারুকের কাছে। রেবেকার দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নিজে অনেকবার শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ, দীপু মনি ও মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবদের তদবিরও করেছিলেন।
এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে শিক্ষা প্রশাসনে একযোগে ৬৭ জন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অতিরিক্ত সুবিধা নিয়ে দলীয় পরিচয়ে শিক্ষাকে ধ্বংস করার চক্রান্তে নিয়োজিত ছিলেন। নতুন ওই পদায়নের তালিকায় সুবিধাবাদী অনেককেই প্রমোশনও দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পদায়নের তালিকায় রয়েছেন বিতর্কিত কারিকুলাম প্রণয়নের ড. মশিউজ্জামানের একান্ত সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একাধিক সদস্য। তারাও এখন নতুনভাবে বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি’র চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম সকালের সময়কে বলেন, উক্ত পাঁচজনের বিষয়ে আমি ‘ডিপিসি’ দিয়েছিলাম। পরে ডিপিসি’র বৈঠক হওয়অর কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই আমি ওখান থেকে চলে এসেছি। এখন ওনারা তদন্ত করে দেখছেন, তাদের পদন্নোতি ঠিক হয়েছি কিনা। তার পরই তারা ব্যবস্থা নিবেন। আর ওখানে কয়েকটি গ্রুপ আছে ত। একজন আরেকজনেস বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
এমএসএম / এমএসএম