নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সাঃ)
নারী, আসলে যিনি রাণী তাকে বলা হয় নারী। নারী হলো পৃথিবীর সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ, এই নারী না হলে আমরা কেউই পৃথিবীর মুখ দেখতামনা, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নারী জাতি ছিল অবহেলিত এবং উপেক্ষিত, সমাজে তাদের কোন অধিকার ছিলনা, অন্য সকল অধিকারের কথা নাই বল্লাম কেননা তাদের বেঁচে থাকার অধিকারই ছিলনা।
এমনকি নারী জাতি মানুষ কি মানুষ এনিয়ে একসময় ছিল সংশয়, সন্দেহ ও বিতর্ক। শুধু এতটুকুতেই ক্ষান্ত নয় বরং নারীকে মনে করা হত শয়তানের প্রতীক। নারী সন্তান জন্ম দেয়াকে নিজেদের দুর্ভোগের কারণ মনে করা হত। পবিত্র কুরআন কারীমে বিষয়টি এভাবে বলা হয়েছে "যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তান (জন্মগ্রহণ)-এর সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে মনে মনে দুঃখ-ক্লিষ্ট হয়। (আন নাহল ৫৮)
তার চেয়েও জঘন্য ছিল যদি কারো কন্যা সন্তান জন্ম নিত তাহলে তাকে জীবিত দাফন করা হত।"এবং যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে, জিজ্ঞেস করা হবে। তাকে কী অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল? (আত-তাক্বীর ৮-৯) ভারত উপমহাদেশে দেড় শতাব্দী আগে প্রচলিত সতীদাহ প্রথা কারো অজানা নয়। এভাবেই নারীকে বঞ্চিত করা হয়েছে জীবন জীবিকার প্রত্যেকটি অধিকার থেকে, তাদেরকে দেওয়া হতনা কোন উত্তরাধিকারী সম্পত্তি, পরিবারের পুরুষ লোকেরাই সকল সম্পত্তি অন্যায়ভাবে ভোগ করত।প্রাক ইসলামী যুগের এসকল প্রথাকে চিরতরে বিলুপ্ত ঘোষণা করে নারীদের জন্য সাম্যের বানী নিয়ে পৃথিবীর বুকে আগমন করেন আল্লাহর মনোনীত রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ। তিনি প্রত্যেক মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তার ন্যায্য হিসসা।
মূলোৎপাটন করেছেন বৈষম্যের। কুরআনে কারীমে বর্ণিত আছে আদম যেমন প্রথম পুরুষ তেমনি প্রথম নারী হাওয়া, তাই নারীকে ভিন্ন জগতের প্রাণী মনে করার সূযোগ নেই, এবং আদম ও হাওয়া থেকে অন্য সকল মানুষের বিস্তার ঘটে। তারা দু'জন আদি মাতা পিতা।প্রাক যুগে নারীর মানুষ হওয়া না হওয়া নিয়ে সংশয় ছিল, কিন্তু ইসলাম এই সংশয় দূর করে নারীকে আদি মাতার মর্যাদা দান করেন। সর্বপ্রথম ইসলাম নারীর বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করেন। জীবিত নারীকে মাটিতে পুঁতে ফেলার মত জঘন্য ও নিকৃষ্টতম প্রথাকে বিলুপ্ত করে ঘোষণা করেন।
إن الله حرم عليكم عقوق الأمهات ووأد البنات.
নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা মায়ের অবধ্যতাকে হারাম করেছেন। হারাম করেছেন জীবিত নারীকে মাটিতে পুঁতে ফেলা। (সহীহ মুসলিম ৪৩৭৫)
এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও তিনি ছিলেন নারীদের প্রতি সহনশীল, যুদ্ধ ক্ষেত্রেও নারী শিশুকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।
দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেছেন নারী জাতি মায়ের জাতি তার পদতলে রয়েছে তোমার জান্নাত সূতরাং তার সেবাকে আবশ্যক করে নাও। পর্যায়ক্রমে ইসলাম নারীকে তার সকল ন্যায্য হিসসা বা অংশ পূর্ণরূপে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাকে দিয়েছে উত্তরাধিকারী সম্পত্তির অংশীদারত্ব। পুরুষদের জন্যও সেই সম্পদে অংশ রয়েছে, যা পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়বর্গ রেখে যায় আর নারীদের জন্যও সেই সম্পদে অংশ রয়েছে, যা পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়বর্গ রেখে যায়, চাই সে (পরিত্যক্ত) সম্পদ কম হোক বা বেশি। এ অংশ (আল্লাহর তরফ থেকে) নির্ধারিত। (আন-নিসা ০৭)
কন্যা সন্তান হত্যা নয় তার লালন-পালনের দায়িত্ব তার বাবার উপর ন্যাস্ত করেছেন।ছেলে সন্তান যেমন লালন-পালন করতে হয় তেমনি কন্যা সন্তানকেও লালন-পালন করা লাগবে।বরং উত্তম পাত্রস্থ করা পর্যন্ত মেয়ে সন্তান লালন-পালন করাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দুটি মেয়ে সন্তানকে সাবালক হওয়া পর্যন্ত প্রতিপালন করে, কিয়ামাতের দিনে সে ও আমি এমন পাশাপাশি অবস্থায় থাকব, এ বলে তিনি তার হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে দিলেন। (সহিহ মুসলিম- ৬৫৮৯)
ইসলাম নারীকে মা হিসেবে সম্মান দিয়েছেন এবং বাবার চেয়ে মাকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। (বনী-ইসরাঈল-২৩)
বাবার চেয়ে মাকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে মায়ের কথা তিনবার বলেছেন আর বাবার কথা বলেছেন একবার।এবং সন্তানের জান্নাত লাভ মায়ের সন্তুষ্টি র মধ্যেই নিহিত। মুআবিয়া ইব্ন জাহিমা সালামী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমার পিতা জাহিমা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খিদমতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি। এখন আপনার নিকট পরামর্শ জিজ্ঞাসা করতে এসেছি। তিনি বললেনঃ তোমার মা আছেন কি? সে বললোঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তাঁর খিদমতে লেগে থাক। কেননা, জান্নাত তাঁর দু’পায়ের নিচে।
(সুনানে আন-নাসায়ী-৩১০৪)
মা হিসেবে ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ অধিকার দিয়েছেন। এমন অধিকারের কথা পৃথিবীর কোন সভ্যতায় বলা আছে আমার জানা নেই।
রাসূল ﷺ নারীকে স্ত্রী হিসেবে সম্মান দিয়েছেন এবং তার জন্য মোহর ধার্য্য করেছেন। নারীকে বিয়ে করতে হলে মোহরের বিকল্প নেই। এবং মোহরের পূর্ণ অধিকার নারীকে দেওয়া আছে।
নারীদেরকে খুশী মনে তাদের মাহর আদায় কর। তারা নিজেরা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা সানন্দে, স্বচ্ছন্দভাবে ভোগ করতে পার।(আন-নিসা-০৪)
নারীর ভরণপোষণের ভার তার স্বামীর দায়িত্বে রাখা হয়েছে।প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খরচা দেবে। (তালাক-০৭)
এবং স্বামী তার স্ত্রীর সাথে ভালো আচরণ করবে, উত্তম আচরণ করবে। আর তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন কর। (আন-নিসা-১৯)
আর তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।(সহীহ বুখারী-৫১৮৬)
স্ত্রীর হকের কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যেমন:
আর স্ত্রীদেরও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, যেমন তাদের প্রতি (স্বামীদের) অধিকার রয়েছে।(আল-বাকারাহ-২২৮)
স্ত্রীদের প্রহার নিষেধ করে বলা হয়েছে,
لا تضربوا إماء الله
‘‘তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে প্রহার করবে না।’’ (সুনানে আবী-দাঊদ-২১৪৬)
এবং পুরুষের সততার ব্যাপারে তার স্ত্রীর সাক্ষ্যকে সর্বাগ্রে রাখা হয়েছে,
তোমাদের মাঝে সে-ই ভাল যে তার পরিবারের নিকট ভাল। আর আমি আমার পরিবারের নিকট তোমাদের চাইতে উত্তম।(তিরমিজি-৩৮৯৫)
বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূল ﷺ নারীদের সাথে সদ্ব্যবহারের কথা বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করে বলেন, জেনে রাখ! তোমাদের যেমন তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি অধিকার আছে, তাদেরও তোমাদের প্রতি ঠিক সেরকমই অধিকার আছে। জেনে রাখ! তোমাদের প্রতি তাদের অধিকার এই যে, তোমরা তাদের উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে।(তিরমিজি-১১৬৩)
প্রসিদ্ধ আছে একজন পুরুষের মহা কর্মের নেপথ্য যেকোনো একজন মহীয়সী নারীর অবদান থাকে। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় প্রথম মুসলিম একজন মহীয়সী নারী ছিলেন। যার নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে হযরত খাদিজা রা.।
ইসলামের জন্য প্রথম শহীদ তিনিও একজন নারী হযরত সুমাইয়া রা.। এবং জ্ঞানীগুণী মানুষের মধ্যে প্রথম কাতারেও নারীদের নাম লিপিবদ্ধ আছে স্বর্ণাক্ষরে, যিনি হযরত আয়শা রা.
এছাড়াও পবিত্র কুরআনে কারীমে নারীদের স্বতন্ত্র একটি সূরা রয়েছে, সূরাতুন নিসা।
মারিয়াম আ. এর নামেও রয়েছে একটি সূরা। ইসলাম কিংবা রাসূল ﷺ নারীদের প্রতি সহনশীলতা ও হৃদ্যতা এবং অধিকার সচেতনতা দেখিয়ে আরো অনেকভাবে নারীকে সম্মানিত করেছেন। যা এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করুন।
এমএসএম / এমএসএম