কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি
কালের বিবর্তনে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় এক সময়ের ধান -চাল ভাঙার একমাত্র অবলম্বন ঢেঁকি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এক সময় বাংলার বুকে নবান্ন এলেই বারহাট্টা উপজেলার গ্রামীণ জনপদে পাড়ায় পাড়ায় ঢেঁকি দিয়ে চাল তৈরি, চাউলের ছাতু, চাউলের গুড়া, চিড়া, মাসকালাইয়ের ডাল, আটা, গম, জব, খির তৈরির চাল বানানোর সেই ঢেঁকি আজ অসহায় হয়ে পড়েছে বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার ইঞ্জিনচালিত মেশিনের কাছে।
সরেজমিনে গত রবিবার থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত বারহাট্টা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ি ছাড়া বেশীরভাগ বাড়িতেই ঢেঁকির দেখা মেলেনি।
উপজেলার বাউসী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে অবশেষ আথানগর গ্রামের ঝর্ণা রাণীর বাড়িতে গিয়ে দেখা মিলল ঢেঁকির ব্যস্ততা। ঢেঁকি তখন ঝর্ণা ও মেয়ে বন্যার অপন ছন্দে নৃত্যরত। মেয়ে বন্যা ঢেঁকির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। এক পায়ের চাপ দিচ্ছেন নির্দিষ্ট তাল, লয়ে। বিপরীত দিকে মা ঝর্ণা ঢেঁকির মাথায় বসে চালগুলোকে বারবার নাড়িয়ে দিচ্ছেন।
ঝর্ণা রাণীর সাথে কথা বললে তিনি সকালের সময়কে বলেন, সামনে পৌষ সংক্রান্তি আসছে তাই আগে থেকেই পিঠা তৈরির জন্য আমরা ঢেঁকিতে আতপ চাল কুটছি। চাল কুটার আগে তিন-চার ঘণ্টা চাল ভিজিয়ে রেখেছি। তারপর চালনিতে রেখে চাল থেকে পানি ঝরিয়েছি। পানি পড়ে গেলে এখন ঢেঁকিতে কুটানো শুরু করেছি। চাল কুটানোর সময়সীমা সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢেঁকিতে তিন কেজি চাল কুটাতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগে।
বায়পুর গ্রামের কৃষক সুরেশ সূত্রধর বলেন, আমাদের বাড়িতে বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রেখতে এখনও একটা ঢেঁকি রেখেছি। ঢেঁকিতে কুটানো আতপ চাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি করা হয়। ঢেঁকিতে কোটা চালের পিঠা খেতে খুবই সুস্বাদু। আতপ চাল ছাড়াও ব্রি-ধান ঊনপঞ্চাশসহ বিভিন্ন চাল দিয়েও পিঠা তৈরি করা হয়।
উপজেলা সদরের গড়মা গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা কৃষ্ণ নন্দী সকালের সময়কে বলেন, একসময় আমাদের অঞ্চলে ঢেঁকিতে ধান ভাঙার ব্যাপক প্রচলন ছিল। ঢেঁকিতে ভাঙা চালের ভাতে অনেক পুষ্টি ও সুস্বাধু। এখন মেশিনে ভাঙা চাল ও ভাতে কোন স্বাদ নেই।
বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোমেন বিশ্বাস বলেন, আগে প্রয়োজনের তাগিদে একমাত্র অবলম্বন ছিল ঢেঁকি। গতিময় সভ্যতায় যাত্রা পথে এখন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষেই তা বিলুপ্ত হতে চলেছে।
তিনি আরও বলেন, এখন সর্বত্রই অসংখ্য যান্ত্রিক ধান ভানার মেশিন ও ভ্রাম্যমান ধান ভানার মেশিন প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ভেঙ্গে দেওয়ায় ঝকঝকে চাল পরিশ্রম কম এবং সময় সাশ্রয় হওয়ার ফলে ঢেঁকির সেই মধুময় ছন্দ কেড়ে নিয়েছে। একসময়ের সেই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রামবাংলা থেকে।
T.A.S / T.A.S