রক্তে কেনা বিজয়ের চেতনায় উদ্ভাসিত হোক হৃদয়
রক্তে কেনা বিজয় কোনো সাধারণ অর্জন নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্ব, আত্মপরিচয়, সম্মান ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে বিজয় সহজে আসে, তা সহজেই হারিয়ে যায়; কিন্তু যে বিজয় আসে রক্ত, ত্যাগ, অশ্রু ও আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে, তা রক্ষা করার দায়িত্বও তেমনি কঠিন ও পবিত্র। আমাদের বিজয় এমনই এক কঠিন মূল্য পরিশোধের ফসল। লাখো শহীদের রক্ত, অগণিত নারীর সম্ভ্রম, কোটি মানুষের অমানুষিক কষ্ট আর সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা ও বিজয় কোনো এক দিনের উচ্ছ্বাস নয়, এটি একটি চলমান দায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান এক নৈতিক চুক্তি। এই চুক্তি ভঙ্গ হলে বিজয় হারিয়ে যায়, পতাকা থাকে কিন্তু আত্মা থাকে না, মানচিত্র থাকে কিন্তু মর্যাদা থাকে না।
বিজয়ের ইতিহাস মানে শুধু যুদ্ধের গল্প নয়; এটি বঞ্চনা, শোষণ, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অবদমন এবং মানবিক মর্যাদার লঙ্ঘনের দীর্ঘ বিবরণ। একটি জাতি যখন দেখে তার ভাষা অবজ্ঞাত, তার ভোট মূল্যহীন, তার শ্রমের ফল অন্যের ঘরে যাচ্ছে, তখন সে বিদ্রোহী হয়, কিন্তু সে বিদ্রোহ হঠাৎ বিস্ফোরণ নয়, এটি দীর্ঘ নীরব ক্ষোভের পরিণতি। এই ক্ষোভের ভাষা কখনো গান, কখনো কবিতা, কখনো মিছিল, কখনো রক্তাক্ত রাজপথ। বিজয় আসে তখনই, যখন মানুষ মৃত্যুকে তুচ্ছ করে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়। কিন্তু বিজয়ের পরই শুরু হয় সবচেয়ে বড় পরীক্ষা, আমরা কি সেই ন্যায়ের পক্ষেই থাকব, নাকি ক্ষমতার লোভে, স্বার্থের টানে, বিভেদের রাজনীতিতে সেই ন্যায়কে বিসর্জন দেব?
রক্তে কেনা বিজয়ের প্রথম শত্রু বিস্মৃতি। যখন আমরা ভুলে যাই কেন লড়াই হয়েছিল, কারা জীবন দিয়েছিল, কী মূল্য দিয়ে এই স্বাধীনতা এসেছে, তখনই বিজয়ের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। স্মৃতিভ্রংশ একটি জাতির জন্য নীরব আত্মহত্যার মতো। স্মৃতি মানে কেবল আনুষ্ঠানিক দিবস পালন নয়, স্মৃতি মানে নীতিতে, আচরণে, রাষ্ট্রচিন্তায় সেই ত্যাগের প্রতিফলন। যদি শহীদের নাম শুধু ফলকে থাকে, কিন্তু ন্যায়বিচারে না থাকে; যদি স্বাধীনতার কথা শুধু ভাষণে থাকে, কিন্তু মতপ্রকাশে না থাকে, তবে বিজয় কাগজে বেঁচে থাকে, বাস্তবে নয়।
বিজয়ের দ্বিতীয় শত্রু হলো বিকৃতি। ইতিহাসকে যখন ক্ষমতার প্রয়োজনে কাটাছেঁড়া করা হয়, সত্যকে ঢেকে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন জাতির নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। ইতিহাস বিকৃতি মানে শুধু অতীতকে বদলানো নয়; এটি ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। কারণ যে জাতি ভুল ইতিহাস শেখে, সে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। বিজয়ের গল্পে যদি ত্যাগের জায়গায় সুবিধাবাদ ঢুকে পড়ে, যদি সংগ্রামের জায়গায় চাটুকারিতা বসে, তবে নতুন প্রজন্ম বিজয়কে অর্জন হিসেবে নয়, ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখে। আর ভোগ্যপণ্য শেষ হলে ফেলে দেওয়া হয়।
বিজয়ের তৃতীয় শত্রু হলো স্বৈরাচার। ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, রক্তে কেনা বিজয়ের ওপর প্রথম আঘাত আসে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ থেকে। যারা স্বাধীনতার নামে ক্ষমতায় আসে, তারা যদি জনগণের ওপরই নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তবে বিজয় পরাজয়ে রূপ নেয়। স্বাধীনতা মানে শুধু বিদেশি শাসনমুক্তি নয়; এটি নাগরিকের অধিকার, মতের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, জবাবদিহি ও মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা। যখন রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকের কণ্ঠরোধ করে, ভিন্নমতকে শত্রু বানায়, তখন বিজয়ের আত্মা ক্ষতবিক্ষত হয়।
বিজয়ের চতুর্থ শত্রু দুর্নীতি। রক্তে কেনা বিজয় নৈতিক উচ্চতায় জন্ম নেয়; দুর্নীতি তাকে নিচে নামিয়ে আনে। দুর্নীতি মানে শুধু অর্থ আত্মসাৎ নয়; এটি ন্যায়বিচারকে বিক্রি করা, সুযোগকে দখল করা, যোগ্যতাকে অবজ্ঞা করা। যখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট হয়, যখন নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য চলে, যখন আইন শক্তিশালীর পক্ষে আর দুর্বলকে দমন করে, তখন বিজয় প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কারণ শহীদরা যে স্বপ্নে প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নে দুর্নীতির কোনো জায়গা ছিল না।
বিজয়ের পঞ্চম শত্রু বিভাজনের রাজনীতি। ভাষা, ধর্ম, অঞ্চল, মতাদর্শ, সবই একটি সমাজের বৈচিত্র। কিন্তু যখন এই বৈচিত্রকে বিদ্বেষে রূপ দেওয়া হয়, যখন ‘আমরা বনাম তারা’ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পায়, তখন জাতির ঐক্য ভেঙে পড়ে। বিজয় আসে ঐক্য থেকে; হারায় বিভেদে। যারা বিভাজনকে ক্ষমতার হাতিয়ার বানায়, তারা বিজয়ের শত্রু, তারা যত বড়ই দেশপ্রেমিক সেজে থাকুক না কেন।
রক্তে কেনা বিজয় রক্ষা করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন। অপরাধীর পরিচয় দলীয় বা আদর্শিক যাই হোক, বিচার হতে হবে অপরাধের ভিত্তিতে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিজয়ের কফিনে শেষ পেরেক। যখন মানুষ দেখে অপরাধ করেও কেউ রেহাই পায়, তখন সে রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বাস হারায়। বিশ্বাসহীন রাষ্ট্রে বিজয় টিকে থাকে না।
দ্বিতীয়ত প্রয়োজন গণতন্ত্রের চর্চা। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়; এটি মতের বহুত্ব, সংলাপ, সমঝোতা ও ক্ষমতার সীমা। নির্বাচন যদি রক্তাক্ত হয়, ভোট যদি ভয়ের মধ্যে হয়, প্রতিষ্ঠান যদি দলীয়করণে ধ্বংস হয়, তবে গণতন্ত্রের খোলস থাকে, প্রাণ থাকে না। রক্তে কেনা বিজয় কোনো একদল বা এক ব্যক্তির সম্পত্তি নয়; এটি জনগণের। জনগণের কণ্ঠকে সম্মান না করলে বিজয় অপমানিত হয়।
তৃতীয়ত প্রয়োজন শিক্ষার মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাসকে প্রশ্নহীন মুখস্থ নয়, বিশ্লেষণী ও মানবিকভাবে শেখাতে হবে। শিক্ষা যদি সত্যকে আড়াল করে, সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য করে, তবে সে শিক্ষা নাগরিক নয়, অনুগত তৈরি করে। অনুগত নাগরিক নয়, সচেতন নাগরিকই বিজয়ের পাহারাদার।
চতুর্থত প্রয়োজন সংস্কৃতির বিকাশ। গান, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, এসব কেবল বিনোদন নয়; এগুলো জাতির আত্মা। যে সমাজে সংস্কৃতি দমিত, সেখানে বিজয় শুকিয়ে যায়। সংস্কৃতি প্রশ্ন করে, আয়না ধরে, স্বপ্ন দেখায়। সংস্কৃতিকে মুক্ত না রাখলে বিজয় বাঁচে না।
পঞ্চমত প্রয়োজন অর্থনৈতিক ন্যায়। ক্ষুধার্ত মানুষকে স্বাধীনতার মর্ম বোঝানো কঠিন। বৈষম্য যত বাড়ে, বিজয় তত দূরে সরে যায়। উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামো নয়; এটি মানুষের জীবনমান, সুযোগের সমতা ও মর্যাদা। যদি উন্নয়নের ফল কেবল অল্প কয়েকজন ভোগ করে, তবে বিজয় সবার হয় না।
রক্তে কেনা বিজয় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও নাজুক। বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্তির খেলা, অর্থনৈতিক নির্ভরতা, ভূরাজনৈতিক চাপ, সবই স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতি, স্বার্থসচেতন কূটনীতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ছাড়া বিজয় নিরাপদ থাকে না। তবে আত্মমর্যাদা মানে বিচ্ছিন্নতা নয়; এটি সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রজন্মের কাছে দায় হস্তান্তর। যারা যুদ্ধ দেখেনি, রক্ত দেখেনি, তারা যদি বিজয়কে শুধু ছুটি বা আনুষ্ঠানিকতায় দেখে, তবে ঝুঁকি বাড়ে। তাদের কাছে বিজয়কে জীবনের নৈতিক মানচিত্র হিসেবে তুলে ধরতে হবে, যেখানে মানবিকতা, ন্যায় ও সাহসের মূল্য আছে। প্রজন্মের সংযোগ ছিন্ন হলে বিজয় স্মৃতিসৌধে আটকে পড়ে।
রক্তে কেনা বিজয় একদিনে হারায় না; এটি হারায় ধীরে ধীরে। যখন আমরা অন্যায়ের সঙ্গে আপস করি, মিথ্যার সঙ্গে সহাবস্থান করি, সুবিধার জন্য নীরব থাকি, তখনই বিজয় ক্ষয়ে যায়। বিজয় রক্ষা মানে কেবল অতীতকে সম্মান করা নয়; এটি বর্তমানকে শুদ্ধ করা ও ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করা।
অতএব, রক্তে কেনা বিজয় যেন হারিয়ে না যায়, এই আকুতি কোনো আবেগী স্লোগান নয়, এটি একটি নীতিগত ঘোষণা। এই ঘোষণার বাস্তবায়ন আমাদের দৈনন্দিন সিদ্ধান্তে, রাষ্ট্রীয় নীতিতে, সামাজিক আচরণে। ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবিকতা ও ঐক্যের পথে অবিচল থাকলেই বিজয় বেঁচে থাকবে। নইলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না, কারণ যে বিজয় রক্তে কেনা, তার অবহেলা সবচেয়ে বড় অপরাধ।
তাই আমাদের সকলেরই উচৎ বিজয়ের চেতনা উজ্জীবিত রাখার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হৃদয়ে ধারণ করা। যাতে কোনভাবেই হারিয়ে যেতে না পারে। রক্তে কেনা বিজয়ের চেতনায়-ই যেন উদ্ভাসিত হয় আমাদের হৃদয়। রক্তে কেনা বিজয়ের উদ্দেশ্য যাতে কোনভাবেই বিলীন হয়ে না যায় তার জন্য পাহারা দিতে হবে প্রতিনিয়ত।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক, সভাপতি, রেলওয়ে জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন।
এমএসএম / এমএসএম
রক্তে কেনা বিজয়ের চেতনায় উদ্ভাসিত হোক হৃদয়
গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর সচেতন আঘাত
গুলির শব্দের মধ্যে তফসিল ঘোষণা,এ কোন গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি?
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, যখন লড়াই হয় অহিংস ও গণতান্ত্রিক!
দলবদলের রাজনীতিতে আদর্শ প্রশ্নবিদ্ধ
গাজায় যুদ্ধ বিরতি নাকি পশ্চিমাদের যুদ্ধের কৌশল
পুতিনের ভারত সফরে কী বার্তা পেল বিশ্ব
নৈতিক ও অস্তিত্বগত সংকটে বিশ্ব
পরিশুদ্ধ রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি
তারেক রহমানের প্রতিশ্রুতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা
জ্বালানি ব্যবস্থায় আমদানিনির্ভরতা কমাতে করণীয়
ইউরোপ আমেরিকার সম্পর্কের টানাপোড়েন