বছর শেষে সময়ের হিসাব মেলানোর তাগিদ
সময়ের বুকে প্রতিটি মুহূর্তই যেন অদৃশ্য এক স্রোতঃস্বিনী নদী। এই নদী কারও জন্য অপেক্ষা করে না, কারও গতি কমায় না, আবার কাউকে স্পর্শ না করে এক মুহূর্তও এগিয়ে যায় না।
পৃথিবীতে মানুষের জীবন শুরু হওয়ার পর থেকেই সময়ের এই অপরিবর্তনীয় নিয়ম মানবসভ্যতার প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি সংস্কৃতি, প্রতিটি ধর্ম ও প্রতিটি জ্ঞানের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ তার সফলতা, ব্যর্থতা, আশা-নৈরাশ্য, উত্থান-পতন সবই সময়ের পরিমণ্ডলে গড়ে তোলে। কিন্তু সব সভ্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ইসলাম সময়কে যে গভীরতা, যে পবিত্রতা, যে আধ্যাত্মিক মর্যাদা দিয়েছে, তা এক অনন্য আলোকবর্তিকার মতো মানুষের চিন্তা-চেতনা আলোকিত করেছে।
ইসলামে সময় কেবল ঘড়ির কাঁটা মাপার কোনো গণিত নয়; বরং সময় হলো হায়াতের মূলধন, ঈমানের পরীক্ষাগার, আমলের পথচালনা এবং পরকালের প্রস্তুতির একমাত্র সুযোগ। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) সময়ের মূল্যকে শুধু উপদেশের মাধ্যমে নয়, বরং নিজের জীবনের প্রতিটি আচরণে, প্রতিটি দিনে, প্রতিটি রাতে রূপায়িত করেছেন। কুরআনে সময়কে আল্লাহ যে মর্যাদা দিয়েছেন, যে কসম করেছেন তা বোঝা মাত্রই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সময়ের ওজন মানুষের ধারণার চেয়েও অনেক গভীর, অনেক বিস্তৃত।
ইসলামের আলোকে সময়ের ধারণা দিলে প্রথমেই চোখে পড়ে মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনযাত্রা। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সময় হয়তো সকাল-দুপুর-বিকাল অথবা দিন-মাস-বছরের হিসাব; কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিতে সময় হচ্ছে হায়াতের প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি আমলের সুযোগ, যা একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বিভিন্নভাবে সময়কে ব্যবহার করেছেন মানুষের অন্তর জাগ্রত করার জন্য কখনো সময়ের কসম করে, কখনো সময়ের পরিবর্তনশীলতা দেখিয়ে, কখনো দিন-রাতের চক্র ব্যাখ্যা করে, আর কখনো মানুষের হায়াতের ক্ষুদ্রতা স্মরণ করিয়ে।
বিশেষত সুরা আল-আসরের সূচনা ‘ওয়াল-আসর’ অর্থাৎ সময়ের শপথ ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানতত্ত্বে সময়ের অবস্থানকে মহামহিমান্বিত করে তুলেছে। মহান আল্লাহ কোনো সাধারণ বিষয়ের শপথ করেন না; তিনি শপথ করেন শুধু সেই বিষয়ের প্রতি, যা মানুষের জীবনে সীমাহীন গুরুত্ব বহন করে। এখানে সময়কে শপথ করা মানে মানুষের সামনে সময়কে এমন এক আয়না হিসেবে তুলে ধরা, যেখানে সে নিজেকে, নিজের আমলকে, নিজের লক্ষ্যকে এবং নিজের পরিণতি স্পষ্টভাবে দেখতে পায়।
তাফসিরকারীরা বলেছেন, এখানে ‘আসর’ শুধু বিকালের সময় নয়; বরং মানবজীবনের পুরো সময়কাল, যুগের পরিক্রমা, মানুষের জীবনচক্র সবকিছুই এর আওতায় আসে। ইসলামে সময়ের গুরুত্ব কেবল আধ্যাত্মিক কোনো বক্তব্য নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ ক্ষতির মধ্যে থাকেই, যদি না সে ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, সত্যের উপদেশ দেয় এবং ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ঠিকমতো গড়া না হলে সে স্বভাবতই ক্ষতিগ্রস্ত। সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে মানুষ ইহকালে ব্যর্থ, আর পরকালে শাস্তিপ্রাপ্ত।
মুমিনের জীবনে সময় একেকটি রত্নের মতো। মুমিনের প্রতিটি সকাল তার কাছে নতুন দায়িত্ব, নতুন আমল, নতুন সুযোগ। তাই নবীজী (সা.) সাবধান করে বলেছেন, ‘দুটি নেয়ামত রয়েছে, অনেক মানুষ যার মূল্যায়ন করে না: স্বাস্থ্য এবং অবসরের সময়।’ এখানে সময়কে দায়বদ্ধতার এক বিশেষ নেয়ামত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ মানুষের হাতে শুধু সময়ই দিয়েছেন, আর কিছুই নয়। শরীর, সম্পদ, জ্ঞান সবই সময়ের ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল।
মানুষের জীবন, মৃত্যু এবং সময়ের সম্পর্কও ইসলামে অত্যন্ত গভীর। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে পরিক্রমা, তা মূলত সময়ের মাধ্যমে নির্ধারিত। আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুস্বাদ গ্রহণ করবে।’ এই মৃত্যু সময়েরই ঘোষণা। মানুষের হায়াত নির্দিষ্ট; তার সময়ের পাতায় প্রতিটি মুহূর্ত লেখা। তাই মৃত্যু ও সময়ের সামঞ্জস্যতা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় সময় নষ্ট করার মতো কোনো সুযোগ ইসলামে অনুমোদিত নয়। প্রতিটি নিশ্বাসই একটি বিনিয়োগ, প্রতিটি দিনই একটি পরীক্ষা এবং প্রতিটি রাতই হিসাব-নিকাশের জায়গা।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে সময় ব্যবহারের যে দৃষ্টান্ত রয়েছে, তা মানুষের জন্য সর্বোচ্চ আদর্শ। নবীজি এমনভাবে সময়কে ভাগ করতেন ইবাদত, দাওয়াত, রাষ্ট্র পরিচালনা, পরিবার, সাহাবাদের শিক্ষা, উম্মতের তত্ত্বাবধান সব যেন মসৃণভাবে একই কাঠামোয় প্রবাহিত হয়। সময়ের এই শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবহারই ইসলামি সভ্যতাকে একটি বৈপ্লবিক গতিশীলতা দিয়েছে। তাঁর জীবন দেখলে অবলোকন করা যায় সময়কে ঠিকভাবে ব্যবহার করাই প্রকৃত সফলতা।
ইতিহাসে সময়ের পরিবর্তন এবং কেয়ামতের নির্দেশনাও ইসলামি দৃষ্টিতে বিশেষ অর্থপূর্ণ। কেয়ামত নিজেই সময়ের চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র। দিন-রাত, মাস-বর্ষ, যুগ-যুগান্তর যে সময়ের স্রোত পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে চলে, সেই সময়েরই একদিন সমাপ্তি আসবে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে কেয়ামতের পূর্ব লক্ষণ নিয়ে যে বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে, তা সময়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টিকে আরও স্পষ্ট করে। সময় কেবল গতিশীলতা নয়, বরং আখেরাতের পথে একটি প্রস্তুতি। প্রতিটি মুহূর্ত কেয়ামতের দিকে অগ্রযাত্রা। তাই সুরা ইনশিকাক, সুরা তাকবির, সুরা ইনফিতার এসব সুরায় আল্লাহ সময়ের ভাঙচুর, আকাশের বিচ্যুতি, তারকার লুপ্ত হওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে জানান সময় একদিন নিজেই ভেঙে পড়বে, মানবজীবনের হিসাব তখন শুরু হবে।
মানুষের সময়ের মাঝে আল্লাহ যে নেয়ামত রেখেছেন, তা সাধারণ চোখে দেখা যায় না। একেকটি দিনই যেন একেকটি নতুন দান। ফজরের সময় আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে মনে করিয়ে দেয় নতুন সুযোগ এসেছে, নতুন আমল এসেছে, নতুন হিসাব শুরু হয়েছে। দিনের শেষে সন্ধ্যার আকাশই বলে আজকের আমল শেষ, এখন হিসাবের খাতা প্রস্তুত করো। দিন-রাতের এই চক্র কেবল পৃথিবীর ভৌত নিয়ম নয়; বরং এটি মানুষের আত্মজাগরণের ধারাবাহিক ব্যবস্থা। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি রাত ও দিনকে একের পর এক করলেন, যাতে মানুষ চিন্তাশীল হয়।’ সময়ের এই বিন্যাস মানুষকে দায়িত্ববোধের ট্রেনিং দেয়।
ইসলামে সময় শুধু ইবাদতের জন্য নয়; বরং ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা, অধ্যয়ন, সংযম, পরিবার-পরিচর্যা, আমানত রক্ষা ও মানবিক দায়িত্ব সবকিছুর ভিত্তি সময়। প্রতিটি দায়িত্বই সময়ের দাবির ওপর দাঁড়িয়ে। কোনো কাজ সঠিক সময়ে না হলে তা ইসলামি দৃষ্টিতে অপূর্ণ বা অকল্যাণকর। যেমন সালাতের সময় নির্ধারিত, রোজার সময় নির্ধারিত, হজের সময় নির্ধারিত ইসলামের সব বড় ইবাদত সময়ের সুনির্দিষ্ট কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত। এখানেই সময়ের পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সময়কে অবহেলা মানে ইবাদতের পরিপূর্ণতা নষ্ট করা।
সময়ের ব্যবহার নিয়ে মুমিনের যে চরিত্র হওয়া প্রয়োজন, তা হলো গঠনমূলক, সচেতন, ধৈর্যশীল এবং লক্ষ্যভিত্তিক। অকারণ কথাবার্তা, অর্থহীন কাজ, বিলম্ব, ফুঁড়ে যাওয়া সময় এসব মুমিনের স্বভাব হতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমার পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটির আগে মূল্য দাও জীবনকে মৃত্যুর আগে, অবসরকে কাজের আগে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের আগে, যৌবনকে বার্ধক্যের আগে আর স্বাস্থ্যকে অসুস্থতার আগে।’ এই বাণী সময় ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ ইসলামি নীতিমালা। ইসলাম সময়কে তিন মাত্রায় ব্যাখ্যা করেছে এক. অুীত : যা চলে গেছে, যার জন্য আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। দুই. বর্তমান : যা সবচেয়ে মূল্যবান, কারণ কাজের সময় একমাত্র এটি।
তিন. ভবিষ্যৎ : যার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, কিন্তু উদ্বেগে জীবন নষ্ট করা যাবে না। মুমিনের কাজ অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া, বর্তমানকে কাজে লাগানো, ভবিষ্যতের জন্য পরিশ্রম করা। সময়কে এভাবে তিনটি বাস্তব দৃষ্টিকোণে ভাগ করে ইসলাম মানুষকে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন শিখিয়েছে।
আজকের পৃথিবীতে আমরা সময়ের ব্যবহারকে যতই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুততর করে তুলছি, ততই মানুষ সময়ের সত্যিকারের মূল্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন বিভ্রান্তি কেবল কয়েক মুহূর্তেই মানুষের দিন, রাত, সপ্তাহকে শূন্যে পরিণত করে দেয়। অথচ ইসলাম মানুষকে সময়ের সত্যিকারের জ্ঞান দিয়েছে অর্থপূর্ণ জীবন, লক্ষ্য নির্ধারণ, আত্মশুদ্ধি, সমাজগঠন এসবই সময় ব্যবহারের অংশ।
ইসলামের আলোকে আমাদের করণীয় হলো সময়কে আমানত হিসেবে দেখা, সময়ের হিসাব রাখতে শেখা, প্রতিটি দিনকে আল্লাহর পথে নিবেদিত রাখা, কা-ইবাদত-চিন্তা-পরিবার সব ক্ষেত্রে সময়ের ভারসাম্য বজায় রাখা। নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার, আজকের দিন কি আমার আমল বৃদ্ধি করেছে? নাকি কমিয়ে দিয়েছে? সময় কি আমার হাত থেকে নষ্ট হয়ে গেছে? নাকি আমি সময়কে কাজে লাগিয়েছি?
একজন সত্যিকারের মুমিন সময়কে এমনভাবে দেখবে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় নেয়ামত, সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এবং সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। সময়কে যিনি রক্ষা করেন, আল্লাহ তাঁর রিজিক, জ্ঞান, দুনিয়া, আখেরাত সবকিছুতে বরকত দান করেন। আর যিনি সময় নষ্ট করেন, তিনি নিজের জীবন, আমল এবং ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে ফেলেন।
সুতরাং ইসলামে সময় এমন একটি সম্পদ, যা মানুষের কবর পর্যন্ত তার সঙ্গী। মৃত্যু এসে শেষ সময়ের ঘোষণা দেয়, আর পরকাল শুরু হয় সময়ের হিসাব থেকে। তাই সময়ের সঠিক ব্যবহারই মুমিনের পরিপূর্ণ সফলতা। সুরা আসরের চূড়ান্ত বার্তা তাই মানুষ ক্ষতির মধ্যে, যদি না সে সময়কে ঈমান, আমল, সত্য ও ধৈর্যের পথে ব্যবহার করে।
এই পৃথিবীতে সময়ই মানুষের একমাত্র মূলধন। এটি হারিয়ে গেলে সব হারায়। আর এই সময়ই যদি আল্লাহর পথে নিবেদিত হয়, তবে মানুষের জীবন হয় নান্দনিক, শান্তিপূর্ণ, সফল এবং চিরস্থায়ী মুক্তির পথপ্রদর্শক। ইসলাম সময়কে শুধু বলে দেয়নি; সময়কে মানুষের আত্মার আলো করে তুলেছে। তাই সময়ের প্রকৃত মূল্য শেখা, সময়কে কাজে লাগানো এবং সময়ের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়াই আজকের মুসলমানের জন্য সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের সময়কে হেদায়েতের পথে ব্যবহার করার তওফিক দান করুন।
Aminur / Aminur
বছর শেষে সময়ের হিসাব মেলানোর তাগিদ
মুমিন হৃদয়ে আরবি ভাষার ভালোবাসা
সচ্চরিত্রের অধিকারী পুরুষের মর্যাদা
কোরআনের হৃৎপিণ্ড যে সুরা
আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করলেও সওয়াব
সুস্থতার নেয়ামত রক্ষা করা জরুরি
নববী আদর্শের নওজোয়ান: ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন-নুমান রিডার
নিরাপদ জীবনের চার উপাদান
ইসলামে মানবাধিকারের শিক্ষা
ঈমান ধ্বংসকারী ফেতনা থেকে আত্মরক্ষা
মানুষের হক নষ্ট করা পাপ
সাহাবিদের মতো জীবন গড়ার শিক্ষা