টাকা দিলে সব হয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে

রাজধানীসহ দেশের মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে নিরাপদে মাদক বিক্রি ও সেবন ছাড়াও নারীদের দিয়ে অসামাজিক কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জীবনে মাদকের ধারে কাছেও যায়নি, এমন ব্যক্তিদের মিথ্যা মাদকাসক্তের অভিযোগে কমান্ডো স্টাইলে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ধরে নিয়ে বন্দী করা হচ্ছে।
এরপর প্রতিদিন অমানসিক নির্যাতন করা হয়। শুধু তাই নয়, হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়েও নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এদের নির্যাতনে একজন মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আবার মাঝে মধ্যেই নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
আর এসব ঘটনা প্রশাসনের নজরে আসার পরও অনৈতিক লেনদেনের কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে না। সম্প্রতি দুই স্ত্রীর বিরোধে রাজধানীর উত্তরায় ‘রেইনবো মাদকাসক্ত নিরাময়কেন্দ্র’ ৩ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সড়কে নিরাময় কেন্দ্রে স্বামীকে মাদকাসক্ত বানিয়ে আটকিয়ে রেখে নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগও উঠেছে।
সূত্র জানায়, গত ২০২০ সালে ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরে ‘মাইন্ড এইড’ নামের নিরাময় কেন্দ্রে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমের নির্মম মৃত্যু হয়। এরপর মাদক নিরাময় কেন্দ্রের নানা অনিয়ম দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠে। এর রেশ না কাটতেই মালিবাগে হলি লাইফ মাদক নিরাময় কেন্দ্রে একই বছরের ২ মার্চ ইয়াসিন নামের এক যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। আর মাঝে মধ্যেই নিরাময় কেন্দ্রে নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছেই।
ভুক্তভোগিরা বলছেন, মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। কথিত মাদকাসক্তদের হাত-পা বেঁধে বৈদ্যুতিক পাখায় ঝুলিয়ে নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। আর এ ঘটনা অর্থের বিনিময়ে করা হচ্ছে। এমন নির্যাতনের মাধ্যমে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাগুলোকে অপমৃত্যু হিসেবে চালানো হচ্ছে। খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তদন্তে ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০-১৫টি ব্যতীত নির্ধারিত মানদণ্ডে উন্নিত হয়নি। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামসহ সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের বালাই নেই। আর অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশের মধ্যে গাদাগাদি অবস্থায় রোগীদের রাখা হয়। এ যেন এক কারাগারের বন্দিশালা।
সূত্র জানায়, দেশে বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে ৩৫৫টি। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪টি। কিন্তু বেশিরভাগ নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্ত শনাক্তে ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা নেই। মৌখিক স্বীকারোক্তি অথবা অভিভাবকের কথার ভিত্তিতে রোগী ভর্তি করা হয়। মানসিক রোগীদেরও ভর্তি করা হচ্ছে। উত্তরায় সুস্থ ব্যক্তিকে মাদকাসক্ত সাজিয়ে নিরাময়কেন্দ্রে নিয়ে ২২ দিন আটকিয়ে নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনাটি প্রকাশ হলে রাজধানীর উত্তরার ‘রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে কর্তৃপক্ষ ভুল স্বীকার করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এর আগেও মাদকাসক্তের মিথ্যা অভিযোগে টাকার বিনিময় আটকিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগীর নাম ফিরোজ আহমেদ। তিনি আশুলিয়ায় পোশাক কারখানার স্টোর ম্যানেজার বলে জানা গেছে।পরিবারের অভিযোগ, ফিরোজের প্রথম স্ত্রী আকলিমা ও তার স্বজনেরা বোরহান দেওয়ান নামের এক ব্যক্তির যোগসাজশে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তাকে রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে ভর্তি করেন। এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সাভারে দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসা থেকে বের হলে তিনি নিখোঁজ হন। স্বামীর খোঁজ না পেয়ে ১৯ দিন পর ফিরোজের দ্বিতীয় স্ত্রী নাজমা সাভার থানায় জিডি করেন।
ফিরোজের মা অভিযোগ করে বলেছেন, তার ছেলের প্রথম স্ত্রী আকলিমা আশুলিয়ার জিরাবোতে থাকেন। তার সন্তান না হওয়ায় গত ১০ বছর আগে ফিরোজ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এ নিয়ে প্রথম স্ত্রীর পরিবার তাকে হয়রানি করে আসছিল। এর আগেও ফিরোজকে আটক করে সাড়ে আট লাখ টাকা আদায় করেছে। আর বোরহান দেওয়ান ফিরোজকে নানা হুমকি দিতেন। গত ১ সেপ্টেম্বর ফিরোজের দ্বিতীয় স্ত্রী জানতে পারেন যে, উত্তরায় মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে তার স্বামীকে আটকে রাখা হয়েছে। বিষয়টি তার পরিবার র্যাবকে জানায়। র্যাব যোগাযোগ করলে নিরাময়কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জানায়, ফিরোজকে বোরহান নামে এক ব্যক্তি নিয়ে গেছেন।
র্যাব সূত্র জানায়, ফিরোজের প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে ১০ বছর আগে এক নারীকে বিয়ে করার বিষয়টি গত চার মাস আগে জানাজানি হয়। প্রথম স্ত্রীর পরিবার আশুলিয়ায় প্রভাবশালী। তারাই ফিরোজকে মাদকাসক্ত সাজিয়ে মাদকাসক্তি রেইনবো মাদকাসক্ত নিরাময়কেন্দ্র উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সড়কে ভর্তি করেন। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এবারই প্রথম নয়, এর আগে ২০১৯ সালে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এক ব্যক্তিকে আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে। আর প্রভাবশালী বোরহান দেওয়ান রেইনবো মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বলে রেইনবোর পরিচালক এফ এম কাউসার গণমাধ্যমে বলেছেন। ফিরোজের মা জান্নাতুল ফেরদৌস অভিযোগ করে বলেছেন, তার ছেলে কখনো মাদক সেবন করেননি। তাকে নির্মম নির্যাতন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশ ও র্যাবের প্রতি অনুরোধ জানান ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ঢাকা উত্তর) মেহেদী হাসান বলেছেন, রেইনবো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নেওয়া একটি প্রতিষ্ঠান। যদি কোনো অনিয়ম করে থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।সূত্র জানায়, হলি লাইফ নিরাময় কেন্দ্রের ঘটনায় এক তদন্ত কমিটি বেশকিছু অনিয়ম পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। পুলিশের এএসপির মৃত্যুর পর একাধিক টিম নিরাময় কেন্দ্রগুলো একযোগে পরিদর্শন করে। তখন দেশের ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ১০-১৫টির সেবার মান সন্তোষজনক পায়। অন্যগুলো নির্ধারিত মানে উত্তীর্ণ হতে না পারায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে।
এ ছাড়া, গত ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর মিরপুর এলাকার ‘ব্রাদার্স’ নিরাময় কেন্দ্র পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হামিমুর রশিদ। ওই প্রতিবেদনে ‘ব্রাদার্স মাদকাসক্তি পরামর্শ কেন্দ্র (বাসা নং-৫৯/ক, রোড নং-৭, উত্তর বিশিল, মিরপুর-১) পরিদর্শনকালে কোনো ডাক্তারের অস্তিত্ব পায়নি। শুধু তাই নয়, জীবন রক্ষাকারী উপকরণাদি ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধও ছিল না।
আবার ‘পরিবর্তন’ নামে অপর এক কেন্দ্র ঘুটঘুটে পরিবেশে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ কম। আবার রাজধানীর নিউ ফিউচার লাইফ নামের আরেকটি কেন্দ্র ১০ বেডের হলেও কমপক্ষে ৪০ জন রোগীর উপস্থিতি পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। প্রত্যেকটি বেডের নিচে ছড়ানো-ছিটানো বিছানাপত্র। বিল্ডিংয়ের ছাদেও অনেক রোগীকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। মাদকাসক্ত চিকিৎসার নামে স্থানীয় গুন্ডা-পান্ডার সহযোগিতায় এখানে অনৈতিক কাজ সংঘটিত হতো বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
সূত্র বলছে, সেবার মান সন্তোষজনক না হলেও নিরাময় কেন্দ্রের মালিকরা বিশেষ ব্যবস্থায় নারকোটিক্স কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ রাখেন। মাসিক পরিদর্শন বইতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনোমতে দায়সারা মন্তব্য লিখে দেন। ফলে নিরাময় কেন্দ্রগুলোর সেবার মানে উন্নয়ন ঘটেনি। উল্টো অনিয়ম দীর্ঘস্থায়ী রূপ পেয়েছে। তবে মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযান চালায় নারকোটিক্স। এ সময় অনিয়মের অভিযোগে লাইসেন্স বাতিল করা হলেও পরে সেগুলো বিশেষ ব্যবস্থায় পুনরায় খুলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নিরাময় কেন্দ্রের মালিক বলেছেন, ‘নারকোটিক্সের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রতি মাসে একবার কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন। তখন তাদের সম্মানে ভালো খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়। পরিদর্শন শেষে উপহারসামগ্রী দিয়ে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়ে থাকে।
নিরাময় কেন্দ্র পরিদর্শনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মাদকাসক্তির জন্য চিকিৎসাধীন রোগীর ৯০ শতাংশই ইয়াবা আসক্ত। অন্যরা হেরোইন, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ অন্য মাদক গ্রহণ করেন। মাদক গ্রহণ না করলেও মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ায় পরিবার নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে। আর নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে অনেকেই মানসিক হাসপাতাল বলে মনে করেন।
এমএসএম / এমএসএম

বিসিক মুদ্রণ শিল্পনগরী প্রকল্পের মাটি ভরাটের প্রিলেভেল সার্ভে কাজে প্রকল্প পরিচালকের অনিয়ম-দুর্নীতি

মাদারীপুরের আলোচিত মিথ্যা মুক্তিযোদ্ধার কোটায় একই পরিবারের চারজন করছেন সরকারি চাকরি

নিষিদ্ধ হলেও হিযবুত তাহরীরের প্রকাশ্যে কর্মসূচী ঘোষণা

মিরপুর ফায়ার সার্ভিসের ট্রেনিং কমপ্লেক্সের অফিসার তৌহিদুলের শাস্তি দাবি

বিসিকের প্রকল্প পরিচালক মোঃ রাকিবুল হাসানের ঘুস-দুর্নীতি সমাচার

জমি ক্রয়ের নামে ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রবাসি স্বামীর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

বিআইডব্লিউটিএ বন্দর শাখার সাবেক পরিচালক সাইফুলের টাকার উৎস কি?

নার্গিসকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি দেওয়া হোক

গাজীপুর গণপূর্তের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল আজিমের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ

গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকের ঢাকায় ১৯ বছরের লুটপাটের রাজত্ব

মসজিদের নামে জমি দখলের চেষ্টা করছে মল্লিক বিল্ডার্স

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ডিজি আবু সুফিয়ান এর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে টেন্ডার বাতিল এর অভিযোগ
