ঢাকা মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

বৃদ্ধাশ্রম, শব্দের দ্যোতনা কতটুকু অমানবিক!


অধ্যাপক ফেরদৌসী পারভিন photo অধ্যাপক ফেরদৌসী পারভিন
প্রকাশিত: ১৯-৫-২০২৩ রাত ৮:২৭

অনেকদিন ধরে হৃদয় স্পর্শ করা বিষয়টি নিয়ে লিখব ভেবেছি কিন্তু হাজার কাজের ভিড়ে আর লেখা হয়ে উঠে না। তবে যখনই কোনো উৎসবাদি আসে এবং ঢাকার বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের ক্যামেরার সামনে তুলে ধরা হয়, তাদের কথা ও অবস্থা তুলে ধরার জন্য তখনই মনে হয় লেখার কথা। তারপর আবার ব্যস্ততায় লেখার সুযোগ খুঁজতে থাকি কিন্তু হয়ে আর ওঠে না। বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস মানুষগুলোর কথা ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করে। আমরা আহা উহু করি। তারপর সব শুনশান। অনেকে আবার নিজ উদ্যোগে খাবার বা উপহার নিয়ে যেয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে আহা আহা করে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে তার দায়িত্ব শেষ করেন বা করি।

 খুব হৃদয়স্পর্শি একটি শব্দ দিয়ে আজকের লেখাটা শুরু করেছি। বৃদ্ধাশ্রম। আমার অবশ্য জানা নাই শব্দটা কেন বৃদ্ধ-আশ্রম না হয়ে বৃদ্ধাশ্রম কেন হলো? নামে কিবা আসে যায়। আশ্রম শব্দের আভিধানিক অর্থ মঠ, ধ্যানকেন্দ্র, সাধনাকেন্দ্র, একই উদ্দেশ্যে একই মনোভাবাপন্ন মানুষের আবাস ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমরা শেষের অর্থটাই ধরে নেব এবং সেটা নিয়ে লিখতে বসেছি।

আমরা যারা মনুষ্যরুপে পৃথিবীতে এসেছি তারা অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে  বেশি সুবিধা পেয়ে থাকি। অন্যান্য প্রাণীর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বলতে গেলে অরক্ষিত হয়ে যায়। বিশেষ করে গৃহপালিত পশু ছাড়া। মানুষের ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয় না। মানুষ তার সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করে সন্তানকে পৃথিবীর সকল আঁচ থেকে রক্ষা করতে। নিজে না খেয়ে, না পরে সন্তানের জন্য ভালোটার ব্যবস্থা করে তাদের অবস্থান থেকে। ফলে বাচ্চারা বুঝতে পারে না তার কতটুকু পাওয়া উচিত। ক্রমান্বয়ে তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে না। প্রায়ই আমরা দেখি উঠতি বয়সের কিশোর মোটরসাইকেল না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর যাকে কষ্ট করে কিনে দিল সে অ্যাক্সিডেন্ট করে প্রাণ হারাচ্ছে। এই অতিরিক্ত ভালোবাসা অনেক সময় শিশুর কনফিডেন্স তৈরি করতে পারে না এবং স্বার্থপর করে তোলে। সে নিজেরটা ছাড়া কিছু বোঝে না। তাই যখন বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে হয় তখন তারা বিরক্তবোধ করে এবং একাধিক ভাইবোন থাকলে বাবা-মাকে ভাগাভাগি করে কে কোথায় থাকবে বা কার কাছে কতদিন থাকবে। এইসব বাবা মায়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের পেছনে সব খরচ করেছেন সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু থাকে না। তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এখানেই বাধে যত বিপত্তি।

বৃদ্ধ বয়সের এই অবহেলা মেনে নেয়া কষ্টকর হয়। বাবা-মা পিংপং বলের মতো সন্তানদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকেন। কখনো বাবা এক সন্তানের বাড়িতে, তখন মা অন্য সন্তানের বাড়িতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। এই ধরনের ঘটনা আমাদের আশেপাশে, সিনেমা, নাটকে অহরহ দেখি। বইয়ের পাতা জুড়ে কত গল্প কাহিনী আমাদের হতাশ করে, কষ্ট দেয়। কিন্তু তারপরও আমরা সন্তানদের কাছে থাকতে প্রবল আকুতি নিয়ে অপেক্ষা করি। সময় থাকতে আমরা নিজের কথা ভাবি না। অনেক ক্ষেত্রে যখন আমাদের বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের প্রয়োজন হয় তখন শুধুই শূন্যতার হাহাকার শুনি। 

পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অভিভাবকরা সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সাধ্যের বাইরে যেয়ে ধার দেনা করে উন্নত দেশে পাঠাচ্ছেন। সন্তান লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি নিয়ে উন্নত জীবন যাপনের জন্য উন্নত দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। দেশে বৃদ্ধ বাবা-মা কখনো শুধু মা অথবা বাবা একা থাকছেন। অনেকের হয়তো টাকা পয়সার সমস্যা থাকে না। কিন্তু যে সমস্যাটি প্রকট হচ্ছে তা তাদের দেখাশোনা করার। পয়সা দিলেও বিশ্বস্ত লোকের অভাব। যে তাদের সততার সঙ্গে দেখাশোনা করবে। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। মেরে ফেলে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই এমন খবর পত্রিকার পাতা দখল করে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লাইভ দেখা যায়। যা মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। এমতাবস্থায় এই অসহায় মানুষগুলোর একমাত্র ভরসাস্থল হতে পারে বৃদ্ধাশ্রম। 

কেন বলছি? আমার আজকের লেখা বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে যে আমাদের নেগেটিভ ধারণা এবং সামাজিক সমালোচনা আছে সেটাকে ইতিবাচকভাবে আমরা দেখতে পারি কিনা ভেবে দেখতে বলবো। যাদের সন্তান বাবা-মাকে দেখে না অথবা দেশের বাইরে থাকার ফলে দেখেশোনা করতে পারে না তারা কোথায় যাবে? কে তাদের বাজার করে দেবে, অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে নেবে? বাড়ির যত বিল সংক্রান্ত কাজ কে করে দেবে? অনেকেই বলবেন আত্মীয়-স্বজন। কিন্ত কয়দিন? রাতে হাসপাতালে নিতে হবে কে নেবে? আর হাসপাতালে রোগীর কাছে কে থাকবে? বাস্তবতা অন্যকথা বলে। সামাজিকভাবে অনেক কথা বলতে পারি কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে ভাবলে মনে হবে নির্ভরযোগ্য বৃদ্ধাশ্রম হতে পারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য অভয়ারণ্য। যদি এই আশ্রমগুলোকে সেভাবে গড়ে তোলা হয়। সেখানে সকলে একটা অ্যাসোসিয়েশন পাবে। তাকে অসুস্থ হলে ডাক্তারের চিন্তা করতে হবে না। বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। প্রচুর বই থাকবে। সকাল বিকাল দল ধরে হাঁটার ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে খেলাধুলার ব্যবস্থা। বাগান করার সুযোগ থাকবে। যিনি পছন্দ করবেন তিনি ফুল ফোটাবেন মন ভালো করা। মাঝে মাঝে দল ধরে বেড়াতে নেবার ব্যবস্থা থাকবে। ধর্মকর্ম করার সুব্যবস্থা থাকবে। এতকিছুর মধ্যে থাকলে মন ভালো থাকবে মানুষগুলোর। ভাবুন তো নিজের বাড়িতে একা একা থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম ভালো না?  
একা ঘরে রাতের প্রহর গুনে একাকিত্বকে সঙ্গী করে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচার চেয়ে, সমবয়সী অনেকের সঙ্গে সময়ের বৈঠা বাওয়া ভালো না?  

অনেকের সঙ্গে থাকলে সন্তানদের জন্যও আর মন এত কাঁদবে না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই মানুষগুলো অনেকেই অনেক ক্রিয়েটিভ কাজ করতেন। তাদেরকে সেই কাজ করার সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। যারা করতে সক্ষম থাকবেন তারা কাজের মধ্যদিয়ে আরো ভালো থাকবেন। এখন কথা হচ্ছে সবকিছু ভালো হওয়া তখনই সম্ভব যখন থাকার ব্যবস্থাপনা প্রফেশনাল এবং মানবিক হবে। যে আশ্রমগুলো করা হবে তা যেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তির জন্য হয়। তাহলেই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে যে ধারণা আমাদের তার থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। 

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। আমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বসবাস করি। তাই ক্যাটাগরিক্যালি এই আশ্রম করা যেতে পারে। যাদের আর্থিক সমস্যা নাই সমস্যা শুধু স্বজনের তাদের জন্য ব্যবস্থাপনা ভালো থাকলে আমার মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমে থাকা নিয়ে সমাজ সমালোচনা করবে না। বয়স্ক মানুষগুলোর কষ্ট কমে যাবে। একদিন দেখা যাবে সন্তানদের মিস করছে না সেভাবে। আর্থিক সামর্থ যাদের কম সরকার তাদের ভর্তুকি দিতে পারে তাহলে তাদের সমস্যা থাকবে না। আর যাদের একেবারেই আর্থিক সামর্থ নাই তাদের জন্য জাকাত এবং ধনী ব্যক্তিদের সাহায্যে ভালোভাবে থাকতে পারবে সন্তানরা তাদের দেখাশোনা না করলেও।
বৃদ্ধাশ্রম সর্ম্পকে আমাদের ধারণা পালটাতে হবে। একটা কথা আছে না, বাবা-মা ৫/৭ টার পেছনে সবটুকু দিতে পারলে সন্তানরা পারে না। সময়ের সঙ্গে তাদের ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে। উপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজতে তারা ব্যস্ত। আর আমরা বাবা-মা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমরা তাদের উন্নত দেশের উন্নত জীবন চাই না? চাই। আর তাই তো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই উন্নত দেশের হাতছানিতে সাড়া দিতে এবং খুশি মনেই দিই। নিজেকে সর্বস্বান্ত করে খরচ যোগাই অনেকেই। 

অন্যদিকে অনেক সন্তান বাবা-মাকে তাদের কাছে নিয়ে রাখতে চাইলেও অধিকাংশ বাবা-মা রাজি হন না। নিজের দেশ ছেড়ে অনেকেই এই বয়সে অন্য দেশে যেতে চান না। আবার অনেকের পক্ষে সন্তানের পক্ষেও বাবা-মাকে নিজের কাছে নিয়ে যেয়ে রাখা সম্ভব হয় না। আমরা যতই ভাবি না কেন বিদেশেই সকল সুখের ভাণ্ডার রয়েছে। বাস্তবতা তা নয়। নিজের হাতে সংসারের সব কাজ করে চাকরি করতে হয়। কঠিন পরিশ্রমের জীবন পরবাসের।

তাই বলি প্রথমত, আমাদের মনে রাখা উচিত সন্তান মানুষ করতে হবে। সেটা বাবা-মায়ের দায়িত্ব। কিন্তু তা যেন কখনো নিজের সাধ্যের বাইরে না হয়। নিজের জন্য ভাবতে হবে। আমরা যেন কখনো না ভাবি ছেলে মানুষ করছি আমার আর ভবিষ্যৎ কি? ছেলে-মেয়ে দেখবে। সন্তানরা দেখে না তা নয়। জীবনের অন্যপিঠও থাকে। আর তাই কারো আশায় না থেকে সামর্থের মধ্যে নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।

জগতের নিয়ম, যতদিন আপনি দিতে পারবেন ততদিন পৃথিবী আপনার। আপনার পরিশ্রমের ফসল সবাই নেবে কিন্তু আপনার ঠাঁই হবে না। ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই- ছোট সে তরী, আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’- এটাই চরম বাস্তবতা।

দ্বিতীয়ত, সন্তান যদি দেশের বাইরে থাকে অথবা বৃদ্ধবয়সে দেখার মতো কেউ না থাকে তাহলে মনকে তৈরি করতে হবে বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসের। সমাজের দায়িত্ব আহা উহু না করে এর ইতিবাচকতা তুলে ধরা। সেই সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ যেন আস্থা অর্জন করতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া। যেন নির্ভয়ে নির্ভর করতে পারেন একজন বয়স্ক মানুষ। হেসেখেলে বাকি সময়টা যেন কাটিয়ে দিতে পারেন।

একটি বিষয় আমার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগে না, উপহার দেওয়ার জন্য যেয়ে নানান প্রশ্ন করা। আমরা ভেবে দেখি না এই প্রশ্নগুলো যাঁদের করা হচ্ছে তাদের ভালো লাগে কিনা। যেকোনো কারণেই বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নেওয়া মানুষগুলোর কেন সন্তান দেখে না বা কয়টা সন্তান, তারা কি করে, কোথায় থাকে? এ ধরনের কথা শুনতে ভালো লাগার কথা নয়। আমার মনে হয় এসব থেকে বিরত থাকা ভালো। একদিন ঘটা করে তাদের কেন পরিবর্তন হবে না। বরং সামাজিকভাবে এই নিবাসগুলোর ইতিবাচকতা প্রচার করা সেই সাথে থাকার ব্যবস্থার উন্নয়ন করা। তাহলে অন্তত কবরে যাবার আগে সমস্ত শেষ হয়ে যাওয়া মানুষগুলো স্বস্তিতে দিন কাটাতে  পারবে। নিজেদের আর অপাংতেয় মনে হবে না।

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ
গাজীপুুর সরকারি মহিলা কলেজ

এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন

ট্রাম্প-উরসুলার বাণিজ্য চুক্তিতে স্বস্তির হাওয়া