হজ ক্যাম্পে প্রথমবার
একেবারে প্রথম দিকে টাকা জমা দিয়েছি বলে তখন পর্যন্ত নির্দেশনা ছিল জমার রসিদ পাসপোর্ট হজ অফিসে দাখিল করার। আর তাই আমরা দুজন রাজধানীর আশকোনায় হজ অফিসে চলে গেলাম সকাল বেলা। সুবিশাল এলাকা জুড়ে এখানে হজ অফিস, হজ ক্যাম্প, মসজিদ, বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ। নিচতলায় আরও আছে হজ ফ্লাইট পরিচালনাকারী তিনটি বিমান সংস্থার (বাংলাদেশ বিমান, সৌদি এয়ারলাইনস ও ফ্লাইনাসের) চেকইন কাউন্টার। এগুলো অবশ্য শুধু হজ মৌসুমে চালু থাকে। একইভাবে আছে এই সময়ের জন্য অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন বুথ।
হজ অফিসে গিয়ে জানলাম, আপাতত পাসপোর্ট জমা নেওয়া হবে না। আগের দিন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাঁরা জমা দিয়েছেন তাদেরটা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। আমরা হজ পরিচালক সাইফুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের এই সরকারি কর্মকর্তা সজ্জন মানুষ। ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দিলেন। জানালেন যে কোভিডের পর এবারই পুরোপুরি হজ উন্মুক্ত করা হয়েছে আর সৌদি আরব নতুন কিছু নিয়মকানুন চালু করেছে।
ফলে বাংলাদেশকে সেগুলো মেনে সব ঠিকঠাক করার জন্য কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি আরও জানালেন যে সরকারি হাজিদের সকল ফ্লাইট ঢাকা থেকে সরাসরি জেদ্দা যাবে। তারপর মাঝখানে হাজিদের আট দিনের জন্য বাসে করে মদিনা থেকে সফর করিয়ে আবার মক্কা আনা হবে হজের জন্য। হজ সেরে তাঁরা জেদ্দা থেকে ঢাকায় ফিরবেন। তবে শেষ দিকের কিছু হাজিকে হজ শেষে মদিনায় নিয়ে ওখান থেকে দেশে ফেরত আনা হবে।
ওখানকার আরেক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম যে ব্যাগ-সুটকেসসহ সবকিছু আমাদের নিজেদেরই সংগ্রহ করে নিতে হবে। বেসরকারি এজেন্সির মতো কোনো কিছুই দেওয়া হবে না। আর হজে যাওয়ার আগেই হজ প্যাকেজের জমাকৃত মোট টাকা থেকে খাবার বাবদ জমা দেওয়া টাকাটা ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে যেন সরকারি হাজিরা নিজেদের ব্যবস্থায় খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন।
সাধারণত সরকারি ব্যবস্থাপনায় দুই ধরনের প্যাকেজ থাকলেও ২০২৩ সালে একটি প্যাকেজই করা হয় যার বিপরীতে হাজি প্রতি ব্যাংকে জমা দিতে হয়েছিল ছয় লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। এ থেকে খাবার বাবদ নেওয়া ৩৫ হাজার টাকা হজে যাওয়ার আগেই যার যার ব্যাংক হিসাবে ফেরত দেওয়া হয়। এদিক মার্চ মাসের শেষের দিকে সৌদি সরকার মিনায় অবস্থানের ব্যয় সামান্য কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে করে বাংলাদেশি প্রতি হাজিকে জমাকৃত টাকা থেকে আরও ১১,৭২৫ টাকা ফেরত দেওয়া হয়। ফেলে সরকারি হাজিরা প্রত্যেকে মোট ৪৬ হাজার ৭২৫ টাকা হজে যাওয়ার আগেই যার যার ব্যাংক হিসাবে ফেরত পেয়ে যাই।
বাংলাদেশ বিমানকে হজের জন্য ডেডিকেটেড ফ্লাইট চালাতে হয় বলে ঢাকা থেকে জেদ্দায় হাজি নিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজকে খালি আসতে হয়। বিমান তাই হাজিদের কাছ থেকে আসা-যাওয়ার পুরো ভাড়া আদায় করে লোকসান পোষানোর জন্য। বছর জুড়ে অনিয়ম-দুর্নীতি-অপচয়ের মধ্য দিয়ে যে লোকসান গুণে, সেটার গচ্চা দিতে হয় সাধারণ যাত্রীদের বিশেষত হাজিদের। সরকার কেন এটা ঠিক করতে পারল না, তা বোধগম্য নয়। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে খুদে বার্তায় আমাদের পিলগ্রিম আইডি নম্বর (পিআইডি) পেলাম। প্রতিটি হাজিকে স্বতন্ত্র একটি পিআইডি দেওয়া হয়। এই নম্বরের বিপরীতেই একজন হাজির যাবতীয় তথ্য-পরিচয় সব ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়।
হজের জন্য সৌদি সরকার ২০২৩ সাল থেকে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে। ইস্কাটনে ওয়াক্ফ অফিসে বায়োমেট্রিক দিতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধে। যে বায়োমেট্রিক অ্যাপের মাধ্যমে দশ আঙুলের ছাপ নেওয়া ও ছবি তোলা হয়, তা শুধু মোবাইল ফোনেই করা যায়। আমরাটা মোটামুটি নির্বিঘ্নে হয়ে গেলেও আমার সহধর্মিণীটার কয়েক দফা চেষ্টা করেও সম্পন্ন করা গেল না। সংশ্লিষ্ট কর্মী পরামর্শ দিলেন যে বাসায় গিয়ে নিজেদের মোবাইল ফোনে চেষ্টা করতে।
বাসায় কয়েক দিন চেষ্টা করেও কাজ হলো না। অগত্যা আবার নিবন্ধন কেন্দ্রে ছোটা। ঈদুল ফিতরের ছুটির পর তখন মাত্র অফিস খুলেছে। তাই কোনো ভিড় নেই। ওখানে কয়েক দফা চেষ্টার পর অবশেষে সফল হওয়া গেল। আসলে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থাও রাখা দরকার। সৌদি সরকারের সঙ্গে আলাপ করে আমাদের দেশে পাসপোর্টের জন্য যেভাবে ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ কম্পিউটারের সঙ্গে হাতের ছাপ নেওয়ার স্বতন্ত্র ডিভাইস যুক্ত করে বায়োমেট্রিক নেওয়া হয়, সেভাবে। তাতে হাজিদের হয়রানি কমবে, সময়ও কম লাগবে। তাছাড়া একবার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়ে গেলে ওটাই যেন পরবর্তীকালে হজ বা ওমরাহ যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যায়, সেটাও নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ, সৌদি আরবের ইলেকট্রনিক তথ্যভান্ডারের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত আছেই।
তো দুজনের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাগজপত্র, কোভিড টিকার সনদপত্রসহ পাসপোর্ট নিয়ে আমি গেলাম আশকোনায় হজ অফিসে জমা দিতে। সেটা এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে। পাসপোর্ট জমা দেওয়ার পর হজ অফিসের পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ৩০দিনের শর্ট প্যাকেজে আমাদের দুজনকে যেন বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটার একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে এলাম। তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে জানালেন। সাধারণত হজের জন্য মক্কা ও মদিনায় মোট ৪২ থেকে ৪৪ দিন অবস্থান করতে হয়। এ ক্ষেত্রে যারা প্রথম ফ্লাইটে মক্কা যান, তারা আবার প্রথম ফিরতি ফ্লাইটে ফিরে আসেন। তবে ৩০ দিনের বিশেষ একটি প্যাকেজও থাকে যা সীমিত সংখ্যক হাজির জন্য। আর এই প্যাকেজের হাজিরা সাধারণত শেষ দিকের ফ্লাইটে গমন করেন। আর হজ শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসেন।
Israt / Israt