বিআইডব্লিউটিএ দুর্নীতি পর্ব-৪
তবুও বহাল তবিয়তে সাইদুর
এক সময় মানুষের বাড়িতে লজিং মাষ্টার হিসেবে কাজ করা সাইদুর এখন নিজের ব্যক্তিগত সেবার জন্য লোক রাখেন অন্তত ডজন খানেক। আর মিল কলকারখানাসহ কতজন হবে তাতো বুঝতেই পারছেন। জানা যায় সাইদুরের সর্ব প্রথম চাকরির শুরুটা হয়েছিল এলজিইডিতে। সেখানে লাভজনক না হওয়ায় চলে আসেন বিআইডব্লিউটিএতে। এরপর সবই ইতিহাস, গাড়ি, বাড়ী, প্লট, ফ্লাট, মিল ফ্যাক্টরি কি নেই তার। কপাল খুলেছে সাবেক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে। সুত্রে জানা যায়, তৎকালীন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, এমপিদের সাথে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে তাদের ছত্রচ্ছায়ায় ভূয়া বিল ভাউচার ও টেন্ডার বানিজ্যের মাধ্যমে।
যেমন সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকায় অপ্রয়োজনীয় ড্রেজার ক্রয়। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পানি উন্নয়ন বোর্ড মিলিয়ে দেশে পাঁচ শতাধিক ড্রেজার রয়েছে। এ ছাড়া নৌপথ খনন ও পলি অপসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নিজস্ব ড্রেজার রয়েছে আরও ৪৫টি। এই ড্রেজারগুলো চালানোর জন্য বিআইডব্লিউটিএর পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় অনেক ড্রেজার বছরের পর বছর পড়েও থাকে। কিন্তু তার পরও সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫টি ড্রেজার ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করছে বিআইডব্লিউটিএ। তাই এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই। তারা বলছেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লাভের জন্য এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেজার কেনা হলে একসময় এগুলো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া সংস্থাটির পর্যাপ্ত জনবল নেই- যারা এই ড্রেজার রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন। ফলে, এই প্রকল্প কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আর্থিকভাবে লাভবান করলেও সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে মারাত্মক।
সে সময় বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের অক্টোবরে একনেকে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হলেও কাজের খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। একদিকে করোনা, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কার্যাদেশ দিয়েও তাদের প্রয়োজনীয় টাকা দিতে পারছিলোনা না সংস্থাটি। ফলে ৩৫টি ড্রেজারের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১১টি ড্রেজার সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এগুলোর জন্য ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। সে সময় ডলার সংকটের কারণে ৭৫ শতাংশ কাজ বাকি রেখেই প্রকল্পটি প্রায় বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটির মেয়াদ আবারো বাড়ানো হয়। ৩৫টি ড্রেজারের মধ্যে রয়েছে ১২ থেকে ২৮ ইঞ্চি মাপের কাটার। এ ছাড়া ৩৫টি কাটার সাকশন ড্রেজার ক্রেনবোট, ৩৫টি অফিসার ও ক্রু হাউসবোট, পাইপ কেরিং ডার্ম্ব বার্জ ১৫টি, ১৭টি বোলার্ড পুলের টাগবোট, ৫টি করে ওয়েল ও ওয়াটার বার্জ, ১০টি সার্ভে ওয়ার্কবোট, ২টি ইন্সপেকশন ভ্যাসেল, ১টি কেবিন ক্রুজার সংগ্রহ, ৮৬ হাজার বর্গমিটার অফিসার ও স্টাফ কোয়ার্টার এবং ডরমিটরি নির্মাণ করার কথা ছিলো প্রকল্পটির আওতায়। প্রকল্পের প্রস্তাবনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে চার শতাধিক নদী রয়েছে। এসব নদীতে বছরে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টন পলি জমা হয়। ফলে নদীর স্র্রোত ও পানি ধারণের ক্ষমতা কমে আসে। গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নদীভাঙনের ঘটনা ঘটে। পর্যাপ্ত খনন যন্ত্রপাতির অভাবে নদীগুলো ঠিকমতো খনন সম্ভব হয় না। গভীরতা কমে এসব নদীতে জলযান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় দেশের প্রধান নৌরুটগুলোর উন্নয়নে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। এর আগে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বাংলাদেশের নদী ড্রেজিং নিয়ে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে বলা হয়, দেশের প্রধান ও মাঝারি নদীগুলো ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনতে ২১৬টি কাটার সাকশন ড্রেজার প্রয়োজন। জানা যায়, বিআইডব্লিউটিএ, বুয়েট ও এমআইএসটির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএর ৪৫টি ড্রেজার এবং টাগবোট ও আনুষঙ্গিক জাহাজ রয়েছে। এগুলো পরিচালনা করার জন্য ১ হাজার ২৬১ জন জনবল প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র ৬০১ জন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দেওয়ায় বাকি প্রায় সাড়ে ৬০০ জনবল সংকট রয়েছে। অনেক ড্রেজার ও সহায়ক জাহাজ রয়েছে যেগুলো পাহারা দেওয়ার লোকও নেই।অপর দিকে ব্রাহ্মপুত্রের পানিতে যাচ্ছে ২৭৬৩ কোটি টাকা, একদিকে খনন অন্যদিকে ভরাট।
খননের পরও জামালপুরের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের বিভিন্ন এলাকায় চর জেগেছে ও বেশির ভাগ অংশে হাঁটুপানি। জামালপুর শহরের পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের পানিতে যাচ্ছে ২৭৬৩ কোটি টাকা, একদিকে নদী খনন অন্যদিকে ভরাট ২,৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ চলছে। সুফল পাওয়া নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা সন্দেহ।
অথচ ব্রহ্মপুত্র নদের এই জায়গা গত বছরই খনন করা হয়। সরকারি প্রকল্পে ব্যয় হয় বিপুল অর্থ। কিন্তু খনন করার পর নদটি আবার প্রায় আগের মতো ভরাট হয়ে গেছে। খননের নামে বালুর ব্যবসা হয়েছে। পরিকল্পিত খনন হয়নি। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কাজ হয়নি। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, যদি তা–ই হতো, এক বছরের ব্যবধানে নদের এই অবস্থা কেন?
সে সময় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ হাতে নেয়। গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ—এই পাঁচ জেলায় নদের ২২৭ কিলোমিটার অংশ খনন করার কথা। কোনো কোনো এলাকায় খনন শেষ, কোনো কোনো এলাকায় কাজ চলছে, কোনো কোনো এলাকায় কাজই শুরু হয়নি। তবে গত কয়েক বছরে যেসব এলাকায় খনন হয়েছে, সেসব এলাকার মানুষ হতাশ। তাঁরা বলছেন, খনন করে কোনো লাভ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে খননের পর বালু ফেলা হয়েছে নদের চরে অথবা একদম তীরে। বর্ষায় সেই বালু আবার নদীতে মিশে নদটি ভরাট হয়েছে। আবার কোনো কোনো এলাকায় বিপুল পরিমাণ বালু নদীর তীরে রাখা আছে। আগামী বর্ষায় পানি এলে তার একাংশ নদে গিয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
সব মিলিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ের সুফল পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। গত বছরের মে মাসে ময়মনসিংহে তরুণেরা খনন হওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে ‘মৃতের চিৎকার’ শিরোনামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন বলে জানা যায়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। প্রস্থ ২০০ মিটার।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এককালের প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র এখন স্রোত ও নাব্যতাহীন। এ কারণে ২০১৮ সালে ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা নদীর সঙ্গে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি খননের জন্য ৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর বড় অংশ ব্যয় (২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা) হবে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খননে। বিআইডব্লিউটিএর প্রকল্পে বলা হয়েছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খননের উদ্দেশ্য হলো নাব্যতা ফিরিয়ে এনে সারা বছর যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল নিশ্চিত করা, যেন শুকনো মৌসুমেও ৯০ মিটার প্রস্থে ৮ থেকে ১০ ফুট গভীর পানি থাকে। ফলে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথে উন্নীত হবে।
কৃষিকাজে পানি সরবরাহ করাও এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, ১২ ফুট গভীরতার নৌপথকে প্রথম শ্রেণি ও ৮ থেকে ১০ ফুট গভীরতার নৌপথকে দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথ বলে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এককালের প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র এখন স্রোত ও নাব্যতাহীন। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খনন শুরু হয় ২০১৯ সালের জুন থেকে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী জুনে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানিয়েছে, কাজ তেমন একটা এগোয়নি। এ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নদটি খননে একই সময়ে ১০০টি খননযন্ত্র বা ড্রেজার দরকার। কাজ করছে ৪৫টি। বরাদ্দ দরকার বছরে ৮০০ কোটি টাকা। পাওয়া গেছে পাঁচ বছরে ৮০০ কোটি টাকা। জানা যায়, বিআইডব্লিউটিএ'র প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত যেমন টেন্ডার, কেনাকাটা, নিয়োগ, বদলিসহ সকল ক্ষেত্রেই সাইদুর সিন্ডিকেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসকল বিষয়ে মন্তব্য জানতে তার হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
এমএসএম / এমএসএম