বিচারকের পা ধরে ক্ষমা চাওয়ানোর খায়েস

মাস ছয়েক আগে লিখেছিলাম ‘জনপ্রশাসনে পেটুয়াদের এখনই থামাতে হবে’। ওই সময় বেশ কয়েকজন মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তা তাদের অধিনস্ত কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষের গায়ে হাত তুলেছিলেন। আর আজ লিখতে হচ্ছে একজন বিচারককে এখনই থামাতে হবে। কিন্তু কেন? কে-ইবা সেই বিচারক? তার নাম রুবাইয়া ইয়াসমিন। তিনি বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক। তিনি গর্হিত, ন্যাক্কারজনক একটি কাজ করেছেন। তিনি তার মেয়ের সহপাঠীর মাকে তার পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে- অভিযোগ পাওয়ার পরই কেন এই লেখা? বিষয়টি খোলাসা করছি। তিনি বাধ্য করুন আর না করুন; তার মেয়ের এক সহপাঠীর মা তার (বিচারক) পা ধরে ক্ষমা চেয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা. রাবেয়া খাতুনের সামনে। একজন অভিভাবক কেন আরেকজন অভিভাবকের পা ধরে ক্ষমা চাইলেন? আপনাআপনি তো আর কেউ কারো পা ধরে ক্ষমা চান না। বিপদে পড়লেই তো পা ধরে ক্ষমা চান। নিশ্চয়ই তাকে ভয় দেখানো হয়েছে। আর সেই ভয় দেখিয়েছেন বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন। তিনি স্কুলে গিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে অভিভাবকদের ফাঁসানোর ভয় দেখিয়েছেন।
বলা যেতে পারে তিনি সেখানে এজলাস বসিয়েছেন। কেননা, বিচারক তো সব সময় সব স্থানে বিচারক। তিনি যেকোনো স্থানকে এজলাস ঘোষণা করতে পারেন। তিনি সরাসরি এজলাস ঘোষণা করেননি বটে; তবে বাকিও রাখেননি। বড় ব্যাপার হলো তিনি তো সেখানে রায় দিয়েছেন। পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। মজার ব্যাপার হলো তিনি নিজেই বিচারক এবং বাদী।
আর আসামি হলো তার মেয়ের সহপাঠীর মা! তার আচরণ তো হীরক রাজাকেও হারি মানিয়েছে। তার আচরণে পুরো জাতি হতভম্ব। তিনি বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করেছেন। দেশের সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে আশাকরি। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ না করলে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি চাপা পড়ে যেত। ধন্যবাদ জানাই শিক্ষার্থীদের; যারা একটি অন্যায়কে রুখে দিতে কিশোর বয়সে রাজপথে নেমে এসেছে। তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তারা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। ভবিষ্যতের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোমরা এভাবেই রুখে দাঁড়াবে মা। তোমরাই পারবে জাতিকে আলোর পথ দেখাতে। তোমাদের হাত ধরেই সব অন্যায়-অনিয়ম দূর হোক বাংলার মাটি থেকে। তোমাদের স্যালুট জানাই।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিনের মেয়ে ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী, সব শিক্ষার্থীর পালাক্রমে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেওয়ার কথা। কিন্তু বিচারকের মেয়ে কখনোই শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেয় না। বিষয়টি নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় তার। সোমবার রাতে স্কুলের একটি ফেসবুকে সহপাঠীদের কটাক্ষ করে একটি পোস্ট লেখে বিচারকের মেয়ে। এতে কয়েকজন সহপাঠী ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানায়। মঙ্গলবার সকালে স্কুলের অভিভাবক সমাবেশে এসে বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন ৩ শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবককে শিক্ষকের মাধ্যমে ডেকে আনেন। ফেসবুকে তাকে ও তার মেয়েকে নিয়ে ‘অপমানজনক কথা’ বলা হয়েছে এমন দাবি করে সাইবার অপরাধের অভিযোগে মামলা করার হুমকি দেন তিনি। অভিভাবকদের ডেকে নিয়ে মামলার হুমকি দেওয়ার এক পর্যায়ে এক শিক্ষার্থীর মাকে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন ওই বিচারক। সেসময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোছা. রাবেয়া খাতুন সেই বিচারকের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের শাসান। ঘটনাস্থলে থাকা শিক্ষক মোবাশ্বেরা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এক ফেসবুক পোস্ট নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ঝামেলা বাধে। মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ওই বিচারক এসে কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের বলেন যে এই শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে তাকে ও তার মেয়েকে নিয়ে অনেক অপমানজনক কথা বলেছেন। তিনি বলেন- এসব লিখলে সাইবার ক্রাইমের মামলা হতে পারে সেটা কি তোমরা জানো? এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর মা এসে বিচারকের পায়ে ধরে ক্ষমা চান।’ শিক্ষক মোবাশে^রা বেগমের কথায় স্পষ্ট হয় যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা করার ভয় দেখিয়েছেন বিচারক এবং তিনি সেখানে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছেন। এখন কমবেশি সবাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে ওয়াকিবহাল। আর সেই মামলা যদি করেন বিচারক নিজে। তাহলে তো কথাই নেই। সুতরাং খুব সহজেই ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি হয় সেখানে। এদিকে বিচারকের মেয়ের সঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন বলেও অভিযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, বিচারকের মেয়ে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেয় না, এটা নিয়ে তাকে কিছু বলা হয় না। ক্লাসে দেরি করে আসলেও তাকে অ্যাটেন্ডেন্স দেন। কিন্তু অন্য শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ করলে প্রধান শিক্ষক আমাদেরকে বলেন, তোমরা আর বিচারকের মেয়ে সমান কথা নয়। প্রতিবাদ করলে তিনি আমাদেরকে টিসি দেওয়ার হুমকি দেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষিক মোছা. রাবেয়া খাতুন তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সব মেয়েই আমার কাছে সমান। স্কুলে মাত্র একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী থাকায় শিক্ষার্থীদের ময়লা তাদের নিজেদেরকেই পরিষ্কার করতে হয়। বিচারকের মেয়ে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু না দেওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাকে ঘর ঝাড়ু দিতে বাধ্য করেছে। এতে বিচারকের মেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়েছে।’ এখন আসি প্রধান শিক্ষকের কথায়। তিনি যে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন; তা তার কথাতেই প্রমাণ হয়। কারণ স্কুলের সব শিক্ষার্থীই সমান। কে বিচারকের মেয়ে আর কে মজুরের মেয়ে, সেটা তো কথা নয়। যদি অন্য দশজন মেয়ে ঘর ঝাড়ু দিলে তারা হতাশাগ্রস্ত না হয়; তাহলে বিচারকের মেয়ে কেন হতাশাগ্রস্ত হবে? আসলে তিনি (প্রধান শিক্ষক) বিচারকের মেয়েকে আলাদা করে দেখেছেন। তিনি পক্ষপাতমূলক আচরণ করে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায়-অপরাধ করেছেন এবং এ জন্য তার বিচার হওয়া উচিত। পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তবে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন। তার মানে তিনি বিষয়টি লুকানোর চেষ্টা করেছেন। এটা তিনি অন্যায় করেছেন। এ কারণে তার বিচার হওয়া উচিত। তিনি আরেকটি অন্যায় করেছেন শিক্ষার্থীদের দিয়ে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেওয়ানোর মাধ্যমে। স্কুলে পরিচ্ছন্নকর্মী থাকতে কেন শিক্ষার্থীরা ঝাড়ু দেবেন- এই প্রশ্ন তো করাই যায়। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দিলে পরিচ্ছন্নকর্মীর কাজ কী? প্রধান শিক্ষক তাকে দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করান কি-না, খতিয়ে দেখা দরকার। ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন বলছে, রাত ৮টায় বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘একজন অভিভাবক আরেকজন অভিভাবককে মাফ চাওয়াতে পারেন না। আমি স্কুলের সভাপতি হিসেবে এই ব্যর্থতা মেনে নিচ্ছি। এখানে একটা বাচ্চাকে বা অভিভাবককে যদি কেউ অপমান করে সেটা আমারও অপমান। আমার মেয়েও এই স্কুলে পড়ে। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের যথাযথ বিচার পাইয়ে দেবো। তিনি বলেন, যদি কখনো শিক্ষক কোনো অন্যায় করে তাহলে আমরা তার বিচার করবো। দরকার হলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সে শিক্ষককে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তোমরা রাইট পজিশনেই আছো। বিচারক যে আচরণ করেছেন সেটার বিচার করবেন জেলা জজ। সেটা তিনি আমাকে বলেছেন। ইতোমধ্যে হাইকোর্ট, আইন মন্ত্রণালয় জেনে গেছে। সেই বিচারকের বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জেলা জজ আমাকে জানিয়েছেন।’ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানাই। কিশোরী শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ক্ষোভের বিষয়টি তিনি অবশ্যই বুঝতে পারছেন। যেহেতু বিচার বিভাগ স্বাধীন, সেহেতু বিচারকের বিষয়ে তিনি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবেন না। কিন্তু তিনি অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সকালের সময়
এমএসএম / এমএসএম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ

কোচিং-এর গোলকধাঁধায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে গুরুত্ব নেই

সাংবাদিকের দল সমর্থন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

ইঁদুরের কৃতজ্ঞতা

নাগরিক সেবা ও প্রত্যাশার সংকট: রাষ্ট্রীয় কর্মচারী কোথায়?

টেকসই সমাজ গঠনে সাম্য একটি অপরিহার্য ভিত্তি

শুভ জন্মাষ্টমী : সত্য, সুন্দর ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় শান্তির বার্তা

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচিতরাই কাশ্মীরের শাসক

স্বৈরশাসকের বিদায়, বিদ্রোহ ও পলায়ন

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারেক রহমান

এপিআই ও এক্সিপিয়েন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা: স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির নবদিগন্ত উন্মোচন
